রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরের গোলচত্বর। চারদিকে সারি সারি উঁচু দালান। এসব দালানে রয়েছে মার্কেট, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস। গোলচত্বর থেকে তিন দিকে গেছে সড়ক। আর এসব দালানের সিঁড়ি হয়ে প্রধান সড়কের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে তৈরি করা হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি অস্থায়ী দোকান। এসব দোকান ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি চাঁদাবাজচক্র। মিরপুর ১ নম্বর ও এর আশপাশের প্রায় ১ কিলোমিটার সড়ক ভাড়া দিয়ে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলে তারা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিলের নামে দোকানপ্রতি ১০০ এবং খাজনার নামেও টাকা তোলা হয়। চাঁদাবাজের এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন কবির হোসেন নামে এক ব্যক্তি। রয়েছে হান্নান মজুমদার ও নয়ন নামে আরও দুজন।
জানা গেছে, কবির নিজেকে হকার্স লীগ নেতা পরিচয় দিলেও আদতে তিনি কোনো পদপদবিতে নেই। যিনি যখন স্থানীয় এমপি বা কাউন্সিলর হন, এই কবির রাতারাতি তারই লোক বনে যান। স্থানীয় থানা পুলিশের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্য। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে এ কবির শাহ আলী থানা এবং দারুসসালাম থানা পুলিশের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের জিমার্ট মার্কেট, মিরপুর নিউমার্কেট, মুক্ত বাংলা মার্কেট, রবিউল প্লাজা, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, সিটি করপোরেশন মার্কেট, হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজ মার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, ছিন্নমূল মার্কেট, আন-নূরী মসজিদ মার্কেট, মা প্লাজা মার্কেট, বাগদাদ মার্কেটসহ আশপাশের জায়গায় কয়েক হাজার হকার ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কবির, হান্নান ও নয়নের হয়ে টাকা তুলতে রয়েছে অন্তত ১৫ জন ‘লাইনম্যান’। যারা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে টাকা তোলার কাজ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে মনির, সগির, মিলন, বিপ্লব ওরফে বাপ্পি, বুলেট ওরফে জামাল, কাল্লু ওরফে জাকির, সুমন, বসুর, মিজান, নুর হোসেন, রাজিব, রুবেল ও সুরুজ।
সরেজমিন মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, মুক্তবাংলা শপিংমলের সামনে সিঁড়ি থেকেই শুরু হয়েছে দোকান বসা। এরপর অন্তত তিনটি লাইন ধরে বসেছে এসব দোকান। মাজার রোড থেকে মিরপুর ১০ নম্বরমুখী সড়কের প্রথম লেন পুরোটাই ফুটপাতের এ ব্যবসায়ীদের দখলে। এরপর ডিভাইডারের ওপরে বসানো হয়েছে শতাধিক মুচি। তারা সড়কের ওপরেই দাঁড় করিয়ে মানুষের জুতা পলিশ করছে। মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেটের সামনে ফুটপাতের এ দোকান বসেছে ছয় লাইন। মুক্তিযোদ্ধা ও শাহ আলী সুপার মার্কেটের মাঝ দিয়ে কাঁচাবাজার গলি। এই গলির দুপাশে দুই শতাধিক দোকান বসানো হয়েছে। এসব দোকানপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা করে। দোকানগুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ। সংযোগের বিনিময়ে বাতিপ্রতি নেওয়া হয় ১০০ টাকা করে। এই বাজারের টাকা উত্তোলন করে সুরুজ।
এরপর শাহ আলী মার্কেট। এই মার্কেটের সামনেও দোকান বসানো হয়েছে তিন থেকে চার লাইন করে। শাহ আলী মার্কেট আর বাগদাদ হোটেলের মাঝ দিয়ে গেছে আরও একটি সরু সড়ক। এ সড়ক গেছে বিশিল পর্যন্ত। সড়কের দুপাশে বসানো হয়েছে দোকান। এভাবে সনি সিনেমা হল থেকে শাহ আলী মার্কেট পর্যন্ত; আর সনি সিনেমা হল থেকে ঈদগাহ মাঠের পাশের সড়ক ঘুরে বায়তুন নূর জামে মসজিদ হয়ে অ্যাপেক্সের শোরুম পর্যন্ত এ পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রক কবির হোসেন। এর ভেতর দিয়ে ছোট আরও কয়েকটি লিঙ্ক রোড রয়েছে। এসব সড়কেও বসানো হয়েছে কয়েক হাজার দোকান। এসব দোকানভেদে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এরপর বিদ্যুৎ বিলের নামে ১০০ টাকা। এসব দোকানদারের কাছ থেকে পুলিশের নাম করে সপ্তাহে আলাদাভাবে তোলা হয় আরও ৫০০ টাকা করে। কেউ নতুন করে দোকান বসাতে চাইলে এককালীন দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
সিটি করপোরেশন মার্কেট থেকে শাহ আলীর মাজার পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে নয়ন। তার হয়ে চাঁদার টাকা তোলে রুবেল হোসেন এবং মনির হোসেন। মুক্তবাংলার অন্যপাশে কো-অপারেটিভ মার্কেটের চাঁদা নেন কবির হোসেন। এরপর থেকে বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ করে হান্নান মজুমদার। হান্নানের হয়ে টাকা তোলে জুলফিকার ও খলিল।
মিরপুর ১ নম্বরের মুক্তবাংলা শপিংমলের সামনের এক ফুটপাতের ব্যবসায়ী কালবেলাকে বলেন, ‘কবির এই এলাকায় রীতিমতো আতঙ্ক। দৈনিক টাকা উত্তোলনের বাইরেও সে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন নামে-বেনামে চাঁদা দাবি করে। তার চাহিদামতো টাকা না দিলে দোকান উঠিয়ে দেওয়া হয়।’
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা টাকা দিয়ে ব্যবসা করেও শান্তিতে নেই। প্রতিদিন দোকানপ্রতি ৪০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। এক সন্ধ্যায় লাইটপ্রতি বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ১০০ টাকা। তাদের দিতে দিতে দিন শেষে আমাদের লাভ কিছুই থাকে না।’
অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন নতুন করে ঝামেলা করতেছে। নতুন এমপি আসার পর থেকে শুনেছি ভাড়ার রেট আরও বাড়াবে।’
যেভাবে উত্থান কবিরের: পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার ৩ নম্বর আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ আমড়াগাছিয়ায় দরিদ্র পরিবারে জন্ম কবির হোসেনের। বাবার নাম হযরত আলী (গুইল)। কবিরের বাবা ছিলেন দিনমজুর। আর কবির মুক্তবাংলা শপিংমলের নিচে গলায় বক্স বেঁধে পান-সিগারেট বিক্রি করতে। সেই কবির রাতারাতি বনে গেছে কোটিপতি।
জানা যায়, রাতে পানের দোকান করার সুবাদে স্থানীয় থানা পুলিশের সঙ্গে সখ্য বাড়ে কবিরের। এক সময় দারুসসালাম ও শাহ আলী থানা পুলিশের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন আব্দুল মান্নান নামে এক ব্যক্তি। কবির ওই ব্যক্তিকে ধর্মের বাবা ঢাকত। ২০০৮ সালে আব্দুল মান্নান মারা গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হয় কবির।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রামের বাড়িতে কবিরের রয়েছে নামে-বেনামে অঢেল সম্পত্তি। সুবিদখালী বাজার ব্রিজের উত্তর পাশে আল মদিনা ট্রেডার্সের সামনের তিনতলা ভবন, আশ্রাফ গ্রিন পার্কের দক্ষিণ পাশে বাউন্ডারি করা প্লট, ব্র্যাক অফিসের পূর্ব পাশে প্লট, সুবিদখালী কলেজ রোড এলাকায়ও রয়েছে আরও একটি ভবন। গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি। উপজেলা সদরে বিশাল আয়তনের ‘কবির মার্কেট’। এ ছাড়া গ্রামের বাড়িতে অন্তত ২০টি মোটরসাইকেল কিনে ভাড়া দেওয়া আছে। ভাড়ায় চলছে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস ও ‘সোনার তরী’ নামে দুটি নাইট কোচ। রাতারাতি কবিরের এ উত্থানে গ্রামের মানুষও হতভম্ব। এ ছাড়া মিরপুর ১ নম্বরে ফুটপাতে রয়েছে তার অন্তত ২০টি দোকান। এসব দোকান দেখভাল করে তার ছোট ভাই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন রাত ৯টার পরে ফেয়ার প্লাজার দ্বিতীয় বেসমেন্টে হয় চাঁদার টাকার ভাগবাটোয়ারা। গত ২৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ প্রতিবেদক সেখানে গিয়েও ঢুকতে পারেননি। দারোয়ানের বাধার মুখে পড়ে ফিরে আসতে হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা ছাড়াও এটি কবির ব্যবহার করে তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে। কবিরের চাঁদাবাজির পুরো এলাকায় লাগানো রয়েছে অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরা মনিটর করা হয় এ অফিস থেকে।
এসব বিষয়ে জানতে কবির হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সে ধরেনি। এরপর বক্তব্য জানতে চেয়ে এসএমএস পাঠালে তিনি এ প্রতিবেদকের নম্বর ব্লক করে দেন।
মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি-দারুসসালাম) জামিল কালবেলাকে বলেন, ‘আমি গতকাল (বুধবার) তুলেছি (দোকান উচ্ছেদ), এর আগের দিনও তুলেছি। আগামীকালও তুলব। সড়ক দখল করে কাউকে দোকান বসাতে দেওয়া হবে না।’ পুলিশের ক্যাশিয়ার পরিচয় দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি খোঁজ নিচ্ছি। কেউ এই ধরনের কাজ করলে সে অ্যারেস্ট হবে। রাতেই (শুক্রবার) তাকে আমরা গ্রেপ্তার করব।’