জাহিদুর রহমান খন্দকারের ভিজিটিং কার্ডে নাম জে. আর খন্দকার। দেশের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ও-লেভেলে ভর্তি হলেও মাদকাসক্ত হয়ে তা ছাড়তে হয়। এরপর রাজধানীর উত্তরায় খুলে বসেন প্রতারণার ‘সদর দপ্তর’। নিজেকে পরিচয় দেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের ঘনিষ্ঠজন। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদায়ন আর পদোন্নতির নামে হাতিয়ে নেন টাকা।
৪১ বছর বয়সী জাহিদুরের এই প্রতারণার বড় সহযোগী তার বাবা মজিবুর রহমান খন্দকার (৭৩)। প্রতারণায় তিনিও কম যাননি। কখনো নিজেকে পরিচয় দেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, আবার কখনো গ্রুপ অব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ছেলের মতোই নাম সংক্ষিপ্ত করে ভিজিটিং কার্ডে লিখেছেন এম. আর খন্দকার। নামের পেছনে আবার পরিচয় দিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
গত শনিবার রাজধানীর উত্তরা-১৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে বাবা-ছেলের প্রতারণার চাঞ্চল্যকর কাহিনি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণ বিভাগ এই অভিযান চালায়।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২-এর সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে, আবার কখনো এপিএস পরিচয় দিয়ে লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন বাবা-ছেলে। তাদের টার্গেট সরকারি চাকরিজীবীরা।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে নিয়োগ থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব, রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে মহাপরিচালক পদে, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের সিনিয়র সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি এবং পুলিশ পরিদর্শকদের থানায় ওসি পদে পদায়নের নামে টাকা হাতানোর পাঁয়তারা করছিল।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের এডিসি মো. সাইফুর রহমান আজাদ কালবেলাকে বলেন, বাবা-ছেলের এই প্রতারক চক্রটিকে গ্রেপ্তারের সময় বেশকিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। এতে তাদের প্রতারণার ধরন উল্লেখ রয়েছে। কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রটি প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের ছদ্মবেশ ধারণ ও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রকল্প পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে আসছিল। আসামি জাহিদুর রহমান জাতীয় শ্রমিক লীগসহ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে পদ রয়েছে জানিয়েও ভুয়া ভিজিটিং কার্ড ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছিল। তার কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সও জব্দ করা হয়েছে।
বাবার সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পরিচয়ে প্রতারণা জাহিদুরের: ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, জাহিদুর শুধু চাকরি দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নন, নিজের বাবা আরেক প্রতারক মজিবুর রহমান খন্দকারের সঙ্গেও প্রতারণা করেন। নিজেই ফোন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকু পরিচয় দিয়ে তার বাবার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তার বাবা লোকজনকে চাকরি দেওয়া ও পদোন্নতি দিতে টাকা হাতানো শুরু করেছিলেন।
গ্রেপ্তারের পর মজিবুর রহমান খন্দকার ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, দুই মাস আগে ছেলে জাহিদুর তাকে জানায় যে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২-এর সঙ্গে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন তাকে। এর কয়েকদিন পর একটি ভুয়া নম্বর থেকে ছেলে নিজেই এপিএস-২-এর পরিচয় দিয়ে ফোন দিয়ে পরিচিত হন। বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার আশ্বাসও দেন। এতে তিনি অর্থের বিনিময়ে চাকরিতে নিয়োগ, বদলির আশ্বাস, পদোন্নতি লোভ দেখিয়ে প্রতারণা শুরু করেন। পরে বুঝতে পারেন, ছেলে তার সঙ্গেও প্রতারণা করেছে।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
মন্তব্য করুন