সেই ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন পর্যন্ত শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি বেসরকারি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। দুটি ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কোনোরকমে চলছে এর কার্যক্রম। উপাচার্য (ভিসি) নেই প্রায় তিন বছর। প্রতিষ্ঠার ২৮ বছরেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) ও কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার)। নানা অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো ইউজিসির কালো তালিকায়। এর আগে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রেজিস্ট্রার ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিবের পদত্যাগ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান ফটকের সামনে সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করেছেন।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব, উপদেষ্টা, খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধেই শিক্ষার্থীদের মূল অসন্তোষ। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাসার কাজের মেয়ে থেকে আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ, ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে টাকা নেওয়া, দফায় দফায় বেতন বৃদ্ধি, নিয়মিত ক্লাস না করেও কোর্স ফি নেওয়া, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বদলি করে দেওয়া, এক বিষয়ে পড়াশোনা করলেও ভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক শামীমা নাসরিন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন পিপলস ইউনিভার্সিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব ও উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তার পিতা অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যোগদানের সময় শামীমা নাসরিনের বেতন ৬০ হাজার টাকা থাকলেও গত দশ বছরে দফায় দফায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সালের পর আর কারও বেতন না বাড়লেও শামীমার ২০ হাজার, তার আস্থাভাজন রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিকীর ২০ হাজার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বেতন ১০ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন। অবশ্য এর মধ্যে শুধু একটি গাড়ির ড্রাইভার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক্ত।
জানা গেছে, শামীমা নাসরিন তার বাসার কাজের মেয়ে হ্যাপি আক্তারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তাকে অফিস সহকারী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। এ ছাড়া তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় রাশিদা বানু তিথীকে চাকরি দিয়েছেন সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে। স্বামীর বন্ধু হারাধন গাঙ্গুলিকে চাকরি দিয়েছেন একাডেমিক ডিরেক্টর হিসেবে। এখন তিনি দায়িত্ব পালন করছেন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যানের। এ ছাড়া রেজিস্ট্রারের বন্ধু নরসিংদী হাতিরদিয়া কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মমিনুল ইসলামকে পিপলস ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে চাকরি দিয়েছেন। শামীমা নাসরিনের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসসি বিভাগের অধ্যয়নরত দুই শিক্ষার্থী মো. ইমন ও মো. শুভকে চাকরি দিয়েছেন ল্যাব সহকারী হিসেবে। আবার নিজের পছন্দের লোকদের বাড়তি সুবিধা দিতে বসিয়েছেন একাধিক পদে। কেউ কথা না শুনলেই তাকে বদলি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুল কাদেরকে বদলি করে বানিয়েছেন ইংরেজি বিভাগের অফিস সহকারী, সুপারভাইজার নাজিম উদ্দিন খোকন ও সহকারী রেজিস্ট্রার রফিকুর রহমানকে স্থায়ী ক্যাম্পাস নরসিংদীতে বদলি করে দিয়েছেন। আবার আস্থাভাজন আমিনুল আশরাফ নামের এক সহকারী অধ্যাপককে জনসংযোগ ও আজ্বিনা শামস নামের আর একজন সহকারী অধ্যাপককে ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। এসব দায়িত্বের কারণে এই দুজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতাসহ অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
জানা গেছে, অধ্যাপক শামীমা নাসরিন ব্যক্তিগত কাজে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে ১৪ লাখ টাকা নেন। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে সেই টাকা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ফেরত দেন।
অধ্যাপক শামীমা নাসরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি একই বিভাগের অধ্যাপক। অথচ পিপলস ইউনিভার্সিটিতে তিনি এমবিএ এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন। এই সুবাদে তিনি কোর্স ফি হিসেবে চার মাস পরপর ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব হিসেবে প্রতি মাসে নেন আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৭ সালের দিকে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধের সময় তিনি কো-অর্ডিনেটরদের কাছ থেকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য দৈনিক ২ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এভাবে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আউটার ক্যাম্পাসের অন্তত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর সনদের বৈধতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আবার ২০১৮ সালে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০ হাজার করে অন্তত ২০ লাখ টাকা সমাবর্তনের জন্য নিলেও এখনো হয়নি সমাবর্তন।
পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, ‘শামীমা নাসরিন ম্যাডাম নানান অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। যে কারণে আমরা তার পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করি। এরপর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আমাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করি।’
এসব অভিযোগ নিয়ে গত বছরের ৩০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মুহাম্মদ নাজমুল হাসান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি একই বছরের ১৪ নভেম্বর ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুহম্মদ নাজমুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে পারি। এরপর প্রথমে তার বিরুদ্ধে আমাদের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিই। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটি শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১৫টি বিষয়ে অনিয়মের প্রমাণ পায় বলে আমাকে জানায়। তবে অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পরে আমি ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অসত্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা। আমার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি একটা আবেগ কাজ করে। যে কারণে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছি।’
হ্যাপি আক্তারকে চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, মেয়েটি ছোটবেলায় তার বাসায় কাজ করত। এরপর সে পড়াশোনা করে চাকরি নিয়েছে। চাকরিপ্রাপ্ত অন্য কেউ তার পরিচিত নয় বলেও দাবি শামীমার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ১৪ লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছিলাম। যথাসময়ে ফেরতও দিয়েছি।’
নিজের ও পছন্দের কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে শামীমা নাসরিন বলেন, ‘রেজিস্ট্রারের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে আরও অনেক আগে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বেতন গত মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তবে ভাইভার নামে ২ লাখ টাকা করে নেওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেননি। আর কানাডা থেকে এমবিএ করার সুবাদে এমবিএ এবং ট্যুরিজম বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মোল্লা কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কথা জেনেছি। তাদের অভিযোগগুলো শুনেছি। সব কিছু খতিয়ে দেখে কেউ অনিয়মে জড়িত প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ কালবেলাকে বলেন, ‘পিপলস ইউনিভার্সিটির অভিযোগগুলো সম্পর্কে জেনেছি। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোও আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। সব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হবে।’