মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়ে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাতে দেশটির আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবারও প্রশাসনিক অঞ্চল বাগো এবং শান ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫ জন। একের পর এক সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর খবর আসছে। পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তার এই নড়বড়ে অবস্থায় দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মেঘাচ্ছন্ন।
২০২১ সালে নির্বাচিত অং সান সু চি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। এরপর শীর্ষ রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় তারা। তখন থেকে সেখানে প্রথমে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়। তাদের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানো হলে শুরু হয় সহিংসতা। চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত অন্তত ২৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে দেশটির রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আঞ্চলিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সমঝোতা হয়। এর পর তারা সম্মিলিতভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে গত অক্টোবরে তাদের মিত্র আরাকান আর্মি সর্বাত্মকভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করে।
এরপর থেকে একের পর এক অঞ্চল ও শহর দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বতর্মানে দেশটির বড় ৩৩৩টি শহরের মধ্যে মাত্র ৭২টির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে সামরিক বাহিনীর। মোট ভূখণ্ডের ৫২ শতাংশের দখল আছে গণতন্ত্রপন্থিদের। ২৩ শতাংশে লড়াই চলছে।
গত দুদিনও বাগো, শান, রাখাইনে দুপক্ষের ব্যাপক লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। জান্তা বাহিনী বাগোতে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে। রাখাইনসহ কয়েকটি রাজ্যে স্থল অভিযানে কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ বাড়িয়েছে তারা। এতে বাগো শহর ও শহরতলিতে বৌদ্ধ সন্যাসী, শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ অভিযানে হতান্তবিন শহরতলিতে শত শত মানুষ আটকা পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, জায়গতী শহরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (কেএনএলএ) সঙ্গে সংঘর্ষের সময় জান্তা বাহিনীর গোলায় ১৫ জন নিহত হন।
কেএনএলএ, তাদের মিত্র বামার পিপলস লিবারেশন আর্মি (বিপিএলএ) ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বুধবার সকালে জান্তার সামরিক ঘাঁটি ইনফ্যান্টি ব্যাটালিয়ন ৭৩-তে প্রথমে হামলা চালায়। এর জবাবে সামরিক বাহিনী এসব গ্রাম ও শহরে ভারী গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালায়। গতকাল দুপুর পর্যন্ত চলে পাল্টাপাল্টি হামলা।
স্থানীয়রা বলছেন, লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার মধ্যে বৃহস্পতিবারের পাল্টাপাল্টি হামলায় কমপক্ষে তিন গ্রামের ৫০০ মানুষ হতন্তাবিন শহরতলিতে আটকা পড়েছে।
এদিকে আরাকান রাজ্যেও সংঘাত ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্রোহী আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলি ও হামলা চলছে। বিশেষ করে এদিন রামরি দ্বীপে সহিংসতা বেশি ছড়িয়েছে। এখানে বেশি কিছু ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
ইরাবতির খবরে বলা হয়েছে, যখন জান্তাবিরোধীরা সশস্ত্র বাহিনীর বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করছে, তখন সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন ও যুদ্ধাপরাধ আইন লঙ্ঘন করে বন্দিদের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি গণতন্ত্রপন্থি ইয়াও ডিফেন্স ফোর্সেসের (ওয়াইডিএফ) দুই কর্মীকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর গাছে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে মারার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ওপর সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এমন বর্বরতা চালিয়েছে। ওই ঘটনার সময় তাদের একজনকে উল্লাস করতে শোনা যায়। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ও গণতন্ত্রপন্থিরা।
এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুপক্ষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দ্য ওয়ারের এক প্রতিবেদনে ভারতের মেজর জেনারেল অশোক কে. মেহতা দ্য ওয়ার বলেন, এ পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে আসিয়ানের দেওয়া পাঁচ দফার প্রস্তাব মেনে নেওয়া। তাহলে যুদ্ধবিরতি মেনে জান্তাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। এতে দেশটির সংসদে সংরক্ষিত সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ থাকা আসনের নিশ্চয়তা থাকবে না। সরকার ও রাজনীতিতে তাদের ক্ষমতা হারাবে। তবে এ পতন মানবে না তারা।
দ্বিতীয় যে অপশন হচ্ছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। তবে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতায় নেই। জান্তার জেনারেলদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও মামলা রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের ওই ‘গেমে’র পরিসমাপ্তির মতো দেখছি।
ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, এখন যদি সামরিক জান্তার পতনও হয়। তাহলেও সংকট আছে। কারণ বহু আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতিবিদরা সমঝোতা করে যে লড়াই করছেন, তাদের প্রত্যেকের দাবিও আলাদা। তাতেও মিয়ানমারের জনগণের সংকট কাটছে না।