জি এম কাদেরকে ধীরে ধীরে মিত্রহীন করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি অংশ। এর মধ্য দিয়েই দলকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা তাদের। রওশনপন্থিদের দাবি, আগামী ৯ মার্চ সম্মেলনের আগ পর্যন্ত একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কাদেরের পক্ষ ত্যাগ করবেন। এর মধ্যে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির বর্ধিত সভায় অংশ নেবেন বেশ কয়েকজন। জাপার প্রেসিডিয়ামের ৯০ ভাগ সদস্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি ১১ সংসদ সদস্যের ৮ জন রওশনের দিকে রয়েছেন। সম্মেলনের পর আইনি প্রক্রিয়ায় দলের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে তারা প্রকাশ্য ঘোষণা দেবেন।
তবে এসব আলোচনাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না দাবি করে কাদেরপন্থিরা বলছেন, চাপ সৃষ্টির জন্যই এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। জি এম কাদেরই জাপার মূল অংশের নেতা।
জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি নেতারা দাবি করেন, এরই মধ্যে ৬৪ জেলার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তাদের। জেলা, উপজেলা, মহানগর ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের কেউ জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকতে চান না। তারা শক্তিশালী জাতীয় পার্টির নবযাত্রায় শামিল হতে চান রওশনের সঙ্গে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের দলের জাতীয় সম্মেলনের পর থেকে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল শুরু হয়। দেবর-ভাবির মধ্যে কোন্দল ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জি এম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশনও তার অনুসারীরা নির্বাচন বর্জন করেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬ আসনে ছাড় পেলেও জাপা ১১টিতে জয়ী হয়। পরাজিত নেতাদের অনেকেই ফল বিপর্যয়ের জন্য দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দায়ী করে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান। এর জেরে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় গত ২৮ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভায় রওশন এরশাদ নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে ‘অব্যাহতি’ দেন। পরদিন নিজেকে দলের বৈধ নেতা দাবি করে নির্বাচন কমিশনেও চিঠি দেন রওশন। যদিও সেই চিঠির শুনানি এখন পর্যন্ত হয়নি।
এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এরই মধ্যে কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াই ইয়া চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছেন জি এম কাদের। শিগগির আরও অন্তত ১০ জনকে বহিষ্কার করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বহিষ্কৃতরা সবাই একে একে রওশনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। এর বাইরেও জি এম কাদেরের নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তুষ্ট অনেক নেতাকর্মী দল ছাড়তে প্রস্তুত বলে রওশনপন্থিদের দাবি।
রওশনপন্থি অংশের মুখপাত্র সুনীল শুভ রায় কালবেলাকে বলেন, ‘জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকা প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অন্তত ৯০ ভাগ আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। সামনে চমক আছে। সেজন্য ৯ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে দলে পরিচিত ছিল সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। গত রোববার রওশনের পাশে বসে সংবাদ সম্মেলন করায় তাকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এগিয়ে যাচ্ছে। সম্মেলনের দিন ও পরে বড় বড় চমক দেখতে পাবেন।’
জানা গেছে, রওশনপন্থি নেতাদের সঙ্গে জাপার অন্তত ১০ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য বৈঠক করেছেন। সেখানে একজন সাবেক এমপিও উপস্থিত ছিলেন। মূলত কাদের অংশের বহিষ্কৃত ও ক্ষুব্ধ নেতারা অন্যদের দলে টানার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর বাইরে দল গঠনে রওশনকে নেপথ্যে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করছেন জাপা থেকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য। বিরোধী দলের চিফ হুইপ না করায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে রওশনের দিকে ঝুঁকেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কালবেলাকে বলেন, ‘দল করার স্বাধীনতা সবার আছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে দল গঠন করতে পারে। জাতীয় পার্টি পাঁচবার ভেঙেছে। কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বে মূলধারার জাতীয় পার্টি এগিয়ে চলেছে। কারও দল গঠন নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত নই। কারা যাচ্ছেন এ নিয়েও ভাবনা নেই। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেউ তাদের অংশে চলে যাচ্ছেন—এমন খবর আমার কাছে নেই।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষে সম্মেলনের জন্য সময় চেয়ে লিখিতভাবে আবেদন করতে হয়। আমরা তা করেছি। আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত দলের কাউন্সিল করার সময় রয়েছে।’
জাপার অন্য একটি সূত্র বলছে, শুধু কেন্দ্র বলে কথা নয়, জেলা ও উপজেলা নেতাদের বাগে আনতে পৃথক কমিটি করেছেন রওশনপন্থিরা। সম্মেলন পর্যন্ত এই কমিটি কাজ করবে। তাদের লক্ষ্য জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে পরিচিত জাপার সব নেতাকর্মীদের নিজেদের বলয়ে আনা। এজন্য সহিদুর রহমান টেপা, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, সোলেয়মান আলম শেঠ, আবুল কাসেমসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দ্রুতই যোগ দিচ্ছেন রওশন অংশে। তারা যোগ দেওয়ার পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতাকর্মী টানার তৎপরতা আরও বাড়বে।
এদিকে রওশনপন্থিদের ডাকা জাতীয় সম্মেলন সফল করতে সাবেক এমপি আব্দুল গাফফার বিশ্বাসকে আহ্বায়ক ও মোল্ল্যা শওকত হোসেন বাবুলকে সদস্য সচিব করে ২৮ সদস্যের খুলনা বিভাগীয় সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব শফিকুল ইসলাম সেন্টু স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।