শাহ আলম খান
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যাংক গুরুত্বের চোখে দেখছে বাংলাদেশকে

অ্যানা বেজার্ডের ঢাকা সফর
বিশ্বব্যাংক গুরুত্বের চোখে দেখছে বাংলাদেশকে

বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৈশ্বিক অবকাঠামো বাস্তবায়ন এবং গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে খারাপ পরিস্থিতিতেও আগের ঋণ সুদাসলে পরিশোধের সক্ষমতা বজায় রাখার সাফল্যেই এমন কদর।

তা ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্কের মধুর ভিত্তি গড়ে দিয়েছে একসঙ্গে পথচলার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন ঘিরে। এতে একে একে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ অনেক কর্তাব্যক্তিই। একই কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকেও বিশ্বব্যাংকের সম্মেলনে করা হয়েছে আমন্ত্রণ এবং দেওয়া হয়েছে বিরল সম্মান। একইভাবে সংস্থাটির নির্বাহী বোর্ডের সভায় অকুণ্ঠ প্রশংসার পাশাপাশি ঋণ কার্যক্রমের আওতায় থাকা বিভিন্ন দেশেও তারা বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন রোল মডেল হিসেবে।

বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার এ তালিকায় বিশ্বব্যাংকের সবশেষ ও নতুন সংযোজন ঘটতে যাচ্ছে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যানা বেজার্ডের বাংলাদেশ সফর ঘিরে। তিনি বাংলাদেশের ঋণমান সক্ষমতা ও সার্বিক অর্থনৈতিক তৎপরতায় যারপরনাই সন্তুষ্ট। আগামীতে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতেই তার এই ঢাকা সফর বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো।

সব মিলে ঋণ প্রদানে বিশ্বব্যাংকের নীতিনির্ধারণী বোর্ড সম্প্রতি বাংলাদেশকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। গত দুই-তিন বছরের নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং পাইপলাইনে থাকা অর্থের ছাড় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে নেওয়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকারী প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করলেই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বের নিম্ন আয়ের ৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে তাদের ঋণ কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি।

বেসরকারি আর্থিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়েছে। বিশ্বের বাজারে তাদের সাফল্য দেখাতে হয়। তারাও বিশ্বের বাজার থেকেই টাকা তোলে। সেখানে যার ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বেশি এবং উন্নয়ন চাহিদাও বেশি, বিশ্বব্যাংকের কাছে তার গুরুত্বও বেশি।

বিশ্বব্যাংক সূত্রমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) সমর্থিত বৃহত্তম কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এর আওতায় বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খাতে ১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৫৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। যার সবই এসেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। এর মধ্যদিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, আরও বেশ কিছু উন্নয়ন সহযোগী থাকলেও স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। ১৯৭১-৭২ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫২ বছরে বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশ ঋণ পেয়েছে ৭৯.৮২৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এককভাবে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে ২৪.৫৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা শতাংশের হারে বাংলাদেশের মোট ঋণের ৩০.৮০ শতাংশ।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যানা বেজার্ডের বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে দাবি করা হয়েছে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে সহায়তাকারী প্রথম উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ছিল অন্যতম। দেশ স্বাধীনের পর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ৪১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে। এই ঋণের বেশিরভাগই অনুদান বা রেয়াতি ঋণ।

ঢাকা অফিস আরও জানায়, অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূত্র ধরেই গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় এক দিনের সফরে ঢাকা পৌঁছান বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যানা বেজার্ড। সফরকালে তার আজ রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং অন্য ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে। এ সময় তার সঙ্গে থাকবেন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইসার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সামনে এখন কয়েকটি ভিশন রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৬ সালে নভেম্বরে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় রয়েছে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে ৫৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে, যেখানে বিশ্বব্যাংকের উল্লেখযোগ্য অর্থায়ন রয়েছে। এ ছাড়া ‘স্মার্ট বাংলাদেশ আইসিটি ২০৪১ মাস্টারপ্ল্যান’ অনুসারে এর চারটি স্তম্ভ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটির আলোকে সরকার ৪০টির বেশি প্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছে। সব মিলে আগামী দিনের বাংলাদেশের বেশিরভাগ উন্নয়ন উদ্যোগেই বিশ্বব্যাংক সম্পৃক্ত হতে যাচ্ছে। তাদের আগ্রহ বাড়ছে। তার নেপথ্য কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৈশ্বিক অবকাঠামো বাস্তবায়নে সাফল্যের সূত্র ধরেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্জাগরণ হয়েছে। তদুপরি বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যখন গোটা বিশ্ব স্থবির, বাংলাদেশও খুব খারাপ সময় পার করছে—ঠিক তখনো আগের ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ সক্ষমতা হারায়নি। হয়তো এসব কারণেই সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ কম। তবে বাংলাদেশে এখনো উন্নয়ন ক্ষুধা প্রকট। ফলে বাংলাদেশেরও বিশ্বব্যাংককে আগামীতে প্রয়োজন হবে বলেও স্বীকার করেন তারা।

জানা গেছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়। ওই বছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রথম ঋণ নেয়। যার পরিমাণ ছিল ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা নেওয়া হয় জরুরি অগ্রাধিকার খাতে। একই বছরের নভেম্বরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়। পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে পানি সরবরাহ খাতের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর পর থেকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ নেয় বিশ্বব্যাংক থেকে। বাংলাদেশে দুটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুনা সেতু) এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন) নির্মাণসহ এ পর্যন্ত ৩০০টি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। এখন নতুন করে চলমান রয়েছে আরও ৫৭টি প্রকল্প।

যদিও গত ৫২ বছরে একবারই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘শীতল সম্পর্ক’ তৈরি হয়েছিল। সেটি হয়েছিল ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে। এর বাইরে সত্তরের দশকে মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রকল্পেই বেশি অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। আশির দশকে কৃষি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে এই সংন্থাটি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে সংস্কারে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়।

পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে আসার পর বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে দাবি করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি মনে করেন, নিজস্ব অর্থায়নে তা বাস্তবায়নে সক্ষম হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে তুলনামূলকভাবে সাফল্যের একটি গ্রহণযোগ্য বা নমুনা দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

১০

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

১১

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

১২

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১৩

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১৪

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

১৫

‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছে’ 

১৬

প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা সিটির কাছেই থাকল

১৭

বাংলাদেশকে লক্কড়ঝক্কড় দেশে পরিণত করেছে আ.লীগ : প্রিন্স

১৮

২০৩০ সালে সাড়ে ৫২ লাখ যাত্রী বহন করবে মেট্রোরেল  

১৯

পেনিনসুলা স্টিলের এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

২০
X