২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির কর্মীরা সারা দেশে তাণ্ডব চালায়। সেদিন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে চার পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ থানার এসআই আবু হানিফ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ২৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০১৮ সালের ৪ মার্চ গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর পাঁচ বছর পার হলেও সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি ওই মামলার।
চার পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার অগ্রগতি নিয়ে গাইবান্ধার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, ‘এই মামলার ১১ আসামি এরই মধ্যে মারা গেছেন। আটজন পলাতক রয়েছেন।
বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন। আসামিদের মৃত্যু, মহামারি করোনা ও আদালতে বিচারক না থাকায় বিচারে কিছুটা ধীরগতি হয়েছে। সাক্ষীদের হাজির করে দ্রুত চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচারকাজ শেষ করা হবে।’
গাইবান্ধার এই ঘটনাসহ ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের হামলায় সারা দেশে পুলিশের ১৬ জন সদস্য নিহত হয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত একটি মামলারও বিচার শেষ হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা জীবন দিলেও বছরের পর বছর অন্ধকারে থেকে গেছে তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার।
পুলিশ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০ বছরেও এসআই শাহাজাহান হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। চট্টগ্রামে পুলিশ তারেক হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। উচ্চ আদালতে ইকবাল, ওমর ফারুক ও খলিলের হত্যা মামলা স্থগিত রয়েছে। নয় বছরেও সিদ্ধার্থ ও মোজাহার হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়নি। ২০১৩ সালে পুলিশ সদস্য আজিজুর রহমান মফিজুর রহমান জাকারিয়া হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তবে সাক্ষীরা উপস্থিত না হওয়ায় এবং উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ থাকায় এসব মামলার বিচার হয়নি।
তারেক হত্যা মামলা বিচারাধীন, ইকবাল হত্যা মামলা স্থগিত:
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জমির কমপ্লেক্সে আগুন দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে এবং মাথায় লোহার খুন্তি ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পুলিশ কনস্টেবল আবু তারেক আরিফকে। এ ঘটনায় ওই বছরের ২ মার্চ লোহাগাড়া থানার উপপরিদর্শক নূরুল ইসলাম বাদী হয়ে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে ৯৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক জসিম উদ্দিন। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একেএম মোজাম্মেল হকের আদালত সাবেক দুই সংসদ সদস্য আ ন ম শামসুল ইসলাম, শাহজাহান চৌধুরীসহ ৯৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় ৩১ আসামি পলাতক ও একজন মারা গেছেন।
অন্যদিকে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়ার কাঞ্চনায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের তাণ্ডব চলাকালে গুলিতে নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল মোহাম্মদ ইকবাল। এই মামলার বিচার চলছিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় থমকে আছে সেই বিচার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ কালবেলাকে বলেন, ‘তারেক হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তবে ইকবাল হত্যা মামলা হাইকোর্ট থেকে স্থগিত হয়ে যায়। শুনানি না হয়ে মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জামায়াত-শিবিরের যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা পুলিশকেই প্রমাণ করতে হবে।’
অন্ধকারে এসআই শাহজাহান হত্যার তদন্ত:
রাজধানীর মতিঝিলে ২০১৩ সালের ৬ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের হামলায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান মারা যান। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় ২৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে উপপরিদর্শক হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আসামিদের সবাই বর্তমানে জামিনে আছেন। অথচ ১০ বছর পার হলেও এ হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি।
তদন্তের বিষয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘এই মামলাটির পরিধি ব্যাপক। অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হতে কত সময় লাগবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে তদন্ত শেষ হলেই আদালত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
চার্জশিটের ৯ বছর পরও বিচার শুরু হয়নি সিদ্ধার্থ হত্যার:
তৎকালীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজশাহীতে নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার। ওই রাতেই নগরীর বোয়ালিয়া থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক রাসিক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলসহ ৮৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এরপর ৯ বছর পার হলেও এ মামলার বিচার শুরু হয়নি। বর্তমানে মামলাটি রাজশাহীর দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠন শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এ মামলার বিষয়ে আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ বলেন, ‘মামলাটির অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হবে। সাক্ষীদের হাজির করে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করা হবে।’
কনস্টেবল ওমর ফারুক হত্যার বিচার উচ্চ আদালতে স্থগিত:
জামায়াত-শিবিরের ডাকে হরতাল চলাকালে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদ চত্বরে জামায়াত-শিবিরের হামলায় সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ওমর ফারুক নিহত হন। ঘটনার প্রায় এক বছর পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন হরিণাকুণ্ডু থানার ওসি মহিবুল ইসলাম আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এতে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা মোতাহার হোসেনসহ ৩৮৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ মো. নবাবুর রহমান ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বিচার চলাকালীন একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমাইল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এ মামলার একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় আর কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।’
কনস্টেবল মফিজুল হত্যার বিচার শুরু হয়নি:
এক দশক আগে আসামি ধরতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের সংঘবদ্ধ আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল মফিজুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ১০ মার্চ খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশির গোলখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কয়রা থানায় হত্যা মামলা করে পুলিশ। ২০১৫ সালের ২১ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির পরিদর্শক সরদার মো. হায়াত আলী। এরপর দীর্ঘদিন মামলাটি উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত ছিল।
২০২২ সালের ৩১ মে ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মো. আব্দুল লতিফ। এ মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে এক নারীসহ পাঁচজন এরই মধ্যে মারা গেছেন। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন— খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম নান্নু ও বিএনপি নেতা মিরাজুল ইসলাম। বিএনপি ও জামায়াতশিবির ছাড়াও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর খুলনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাটি দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে।
খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শেখ এনামুল হক বলেন, ‘চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে একটি মামলা এসেছে। মামলাটি এত দীর্ঘসূত্রতায় কেন পড়ল জানি না। নথি না দেখে আসলে কিছু বলা যাবে না।’
মোজাহার হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়নি:
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রংপুরের পীরগাছা রেলস্টেশনে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় সংঘর্ষে পীরগাছা থানার ওসিসহ ৩৫ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে আহত পুলিশ সদস্য মোজাহার আলী পাঁচ দিন পর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় পীরগাছা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান বাদী হয়ে উপজেলা জামায়াতের আমির মোত্তালেব হোসেন ও সেক্রেটারি বজলুল রশীদ মুকুল, সদস্য বেলাল হোসেনসহ ৭১ জনের নাম উল্লেখসহ মোট দেড় হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ১৫৯ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। বর্তমানে মামলাটি রংপুরের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল মালেক কালবেলাকে বলেন, ‘মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা থাকা উচিত। এ মামলার বিচার শেষ করার জন্য আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
কনস্টেবল খলিল হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত:
২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ চলাকালে কর্তব্যরত অবস্থায় রাজধানীর বাংলামটর মোড়ে পেট্রোল বোমায় নিহত হন কনস্টেবল ফেরদৌস খলিল। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করে। ওই মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ৪ মে মির্জা ফখরুলসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন রমনা মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. আলী আক্কাছ। এ মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। তবে বিচার শুরু হওয়ার আগেই উচ্চ আদালত এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে। ফলে চার্জশিট দাখিলের সাত বছর পরও এ হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়নি।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুল্লাহ আবু কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশ হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ (স্টে) থাকলে তো আমাদের কিছু করার নেই। উচ্চ আদালত থেকে স্টে ভ্যাকেট হয়ে এলে আমরা সাক্ষী উপস্থিত করে বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করব।’