দেশের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক যৌন হযরানির অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) এক ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিছুদিন আগে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেওয়া একটি নীতিমালা রয়েছে। যৌন হয়রানির মতো স্পর্শকাতর এসব অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সেই নীতিমালার অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে অভিযোগকারী বিচার পাচ্ছেন না। আবার কখনো কখনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম-পরিচয় প্রকাশ করে তার মানহানি করা হচ্ছে।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা (গাইডলাইন) জারি করেন। হাইকোর্টের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে কর্তৃপক্ষকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এ অভিযোগ গ্রহণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে অভিযোগকেন্দ্র স্থাপন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দিতে হবে এ-সংক্রান্ত কমিটির কাছে। তবে বিলম্বে অভিযোগ দিলে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। অভিযোগ দাখিলের ৩০ দিনের মধ্যে সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকার মৃত্যুর পর জানা গেছে, তিনি চার মাস আগে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটার নিষ্পত্তি করেনি। নীতিমালা অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তি শাস্তি পেতেন। আর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী শাস্তির মুখোমুখি হতেন; কিন্তু নীতিমালার অনুসরণ করে সেটা করা হয়নি।
রিটকারী আইনজীবী জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, যৌন হয়রানির অভিযোগ নিরসনের ক্ষেত্রে একদিকে অনেক প্রতিষ্ঠানে এই নীতিমালা মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে মানলেও ওই নীতিমালার অনুসরণ করা হচ্ছে না। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মিডিয়ায় নাম প্রকাশ প্রসঙ্গে বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগে তো মিডিয়ায় নাম যাবে না; কিন্তু মিডিয়া দিয়ে দিচ্ছে। মিডিয়া কেন অভিযুক্তদের নাম ছাপছে? সাংবাদিকতার নৈতিকতা কোথায়? এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযোগ প্রমাণের আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় পাবলিকলি দেওয়া হচ্ছে। এটা সঠিক হচ্ছে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি এটা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। ভারতে এটা মানা হচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশে মানা হচ্ছে না।
অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্বের ব্যাপারে তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকটা কেইস নিয়ে বসেছিলাম। এসব অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে কাউকে কাউতে তদন্তের আগেই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত তাড়াতাড়ি হচ্ছে না কেন, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বলেছে, এটা তাড়াতাড়িই করব। আসলে সময়মতো তদন্ত হচ্ছে না। দীর্ঘদিন পড়ে থাকছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, সব সেক্টরেই এখন যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে; কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া নীতিমালা অনুযায়ী এখনো সব প্রতিষ্ঠানে এ-সংক্রান্ত কমিটি হয়নি। আবার কমিটি থাকলেও তা ঠিকমতো কাজ করে না। কমিটি কাজ করলে আজ অবন্তিকার আত্মহত্যার মতো ঘটনা নাও ঘটতে পারত।
তিনি বলেন, এই নীতিমালা একটা আইন। এটা সবাইকে অনুসরণ করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী তদন্ত পর্যায়ে অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী কারও পরিচয়ই প্রকাশ করা যাবে না। তদন্ত কমিটি এটা প্রকাশ করবে না। তবে তদন্তের পর এটা মামলা পর্যায়ে গেলে, কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে তো নাম প্রকাশ পেয়ে যাবে।