দীর্ঘ ৮ বছর পর রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ফয়েজ আহমেদ নিজু সভাপতি ও মো. রুবেল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। গত বুধবার রাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে সমালোচনা।
দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেউই বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী নন। যদিও ফয়েজ বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তখন তিনি তৎকালীন সভাপতি মুজিবুর রহমান অনিকের রাজনীতি করতেন। অভিযোগ ছিল, দল ভারি করতে ফয়েজকে বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দিয়েছিলেন অনিক। বিষয়টি নিয়ে সে সময়ও সমালোচনা হয়। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে অনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফয়েজ ২০১১-১২ সেশনে রাজধানীর মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক করেন। ২০১৬ সালে তার স্নাতক চতুর্থ বর্ষের (অনিয়মিত) পরীক্ষার রোল নম্বর ছিল ৬১২৩০৮৬ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ২১৮৬০৫২। এখানেই শেষ নয়; ফয়েজের একাধিক জুয়া খেলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি একটি ঘরের মেঝেতে বসে জুয়া খেলছেন। এ সময় তাকে টাকা গুনতেও দেখা যায়।
এসব বিষয়ে জানতে নতুন কমিটির সভাপতি ফয়েজকে ফোন দেওয়া হলে তিনি নিজেকে বাঙলা কলেজের ছাত্র দাবি করেন। বলেন, একটি মহল তাকে বিতর্কিত করতে এসব গুজব ছড়াচ্ছে। এরপর তিনি নিজেকে বাঙলা কলেজের ছাত্র দাবি করে কয়েকটি মার্কসিট পাঠান। যেখানে তিনি নিজেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের মাস্টার্সের অনিয়মিত শিক্ষার্থী দাবি করেন। মার্কসিটের ওপরে লেখা রয়েছে, মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার-২০১৮ স্পেশাল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের তথ্যানুযায়ী, ৫ থেকে ৬ বছরের বেশি মাস্টার্সের রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ থাকে না।
অন্যদিকে, কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক রুবেল নিজেকে বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি হিসেবে পরিচয় দিলেও বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অনিক ও সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান মিয়া জীবনের ওই কমিটির তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত ওই কমিটির ২১ জন সহসভাপতির মধ্যে রুবেল হোসেন নামে কেউ নেই।
এ ছাড়া রুবেলও বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিতে ছাত্রলীগের দপ্তর সেল থেকে তার জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, রুবেল নিজেকে মাস্টার্স শেষ বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়েছেন। নিজের ছাত্রত্ব প্রমাণের জন্য জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে এ প্রত্যয়নপত্রটি জমা দেন তিনি। যেখানে রোল নম্বর উল্লেখ করেছেন ৩৭৪৩১ এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করেছেন ৬১৫৩০০০৬৭৬৭। তবে বাঙলা কলেজে এই রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বরে কোনো শিক্ষার্থীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৭-১৮ সেশনের মাস্টার্সের ১২৪ শিক্ষার্থীর সব তথ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সংগ্রহ কর হয়। ওই সেশনের ১২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে রুবেল নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও তার প্রত্যয়নপত্রের স্বাক্ষরটি কলেজ অধ্যক্ষের নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুবেল বিএসএস ডিগ্রি প্রাইভেট (অনিয়মিত) পড়ছেন। তার সেশন ২০১৪-১৫। তার দ্বিতীয় বর্ষের রোল নম্বর ১৬২০০৪৭৩৩, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৬১৫৩০০০৬৪৫৭। রুবেল দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় ৩টি বিষয়ে পাস করেছেন এবং ৩টিতে ফেল করেছেন। ফল প্রকাশ হয় ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই। এরপর তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় তিনি ইংরেজিতে ফেল করেন এবং আর একটি বিষয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। ফল প্রকাশ হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে। এরপর ইমপ্রুভমেন্ট দিলেও তিনি পাস করতে পারেননি।
জানা যায়, সরকারি বাঙলা কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকাকালে ডিগ্রি কোর্স ছিল। এরপর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে ডিগ্রিতে ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন সভাপতি ফয়েজ আহমেদ নিজু ও সাধারণ সম্পাদক মো. রুবেল হোসেনকে কখনো ক্লাসরুমে দেখেননি কোনো শিক্ষক। কয়েকজন জানান, নিজু মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত শুনেছি। অনিক যখন কলেজের প্রেসিডেন্ট ছিল, তখন তাকে অনিকের সঙ্গে ঘুরতে দেখছিলাম। আর ছাত্রলীগ নেতা রাহুলের বন্ধু রুবেল।
নতুন কমিটির এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, নিজু ও রুবেল এরা কেউই বাঙলা কলেজের ছাত্র নয়। সংবাদ প্রকাশের পরে দেখলাম একজন প্রাইভেট ডিগ্রি এবং প্রাইভেট মাস্টার্সের ছাত্র দাবি করে কাগজপত্র হাজির করেছে। ২০১৬ সালের পর থেকে কলেজে কোনো ডিগ্রি নেই। আর প্রাইভেট ডিগ্রি এবং প্রাইভেট বা প্রিলিমিনারি মাস্টার্সের স্টুডেন্টকে বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা হয় না। এটা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের সান্ধ্যকালীন কোর্সের মতোন। সেখানে কলেজের বিপুলসংখ্যক ত্যাগী ও পরিশ্রমী নিয়মিত শিক্ষার্থী থাকার পরেও অছাত্রদের নেতা বানানোর কোনো মানে হয় না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রুবেলের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কমিটির বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে কালবেলার প্রতিবেদক প্রশ্ন করলে তিনি ফোন কেটে দেন।
ছাত্র না হয়েও কীভাবে ঐতিহ্যবাহী বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদে তাদের জায়গা হলো তা জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে ফোন দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, তারা দুজনেই সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র। নিজু মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছে, এটা ঠিক। তবে সে বাঙলা কলেজেও ভর্তি হয়েছিল। আর রুবেল ডিগ্রির ছাত্র। ছাত্রলীগের দপ্তর সেলে জমা দেওয়া সিভির বিষয়ে একাধিকবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এখন ও ডিগ্রির ছাত্র। এটা চেক করেন। তবে সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।