

জাকার্তা: এশিয়ার হৃৎপিণ্ড
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী মেগা সিটিগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ জাভার পশ্চিমাংশে অবস্থিত এ উপকূলীয় শহরে বসবাস করছেন ৪ কোটি ১৯ লাখ মানুষ। গত ২৫ বছরে জাকার্তার জনসংখ্যা পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জাকার্তার এ নাটকীয় বৃদ্ধির মূল কারণ হলো অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। গ্রামাঞ্চলের মানুষ উন্নত নাগরিক সুবিধা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের খোঁজে শহরে ঢুকে পড়ছেন। জাকার্তা এখন এক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হাব। শহরের অবকাঠামো যেমন আধুনিক, তেমনি পরিবহন, আবাসন ও নগর সেবা শহরের নাগরিকদের জন্য ক্রমশ চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতিদিন ঘনবসতিপূর্ণ সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। এ নগর শুধু জনসংখ্যার হিসাবেই নয়, বরং প্রযুক্তি ও অর্থনীতির দিকেও বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।
টোকিও: স্থিতিশীল বৃদ্ধির মডেল
জাপানের রাজধানী টোকিও একসময় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগর ছিল। বর্তমানে ৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ এ শহরে বসবাস করছেন। গত ২৫ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। টোকিওর এ স্থিতিশীলতা আসে উন্নত অবকাঠামো, কার্যকর নগর পরিকল্পনা এবং উন্নত নাগরিক সেবার কারণে। এটি প্রমাণ করে, মেগা সিটি শুধু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফল নয়; দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও শহরকে মেগা সিটি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
ম্যানিলা: যেখানে অপরাধ ও দূষণের মাত্রাও বেশি
ফিলিপাইনের ম্যানিলা শহরেও ২ কোটি ৪৭ লাখ মানুষের বসতি, যেখানে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দূষণ এবং অপরাধ নাগরিক জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ। ১৫৭১ সালে গোড়াপত্তন হওয়া এ নগরের লোকসংখ্যা গত শতাব্দীতে দ্রুতগতিতে বেড়েছে, তবে শেষ ১০ বছরে গতি অনেকটা কমে গিয়েছিল। ম্যানিলা শত শত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও জাপানের শাসনে ছিল। কিন্তু কেউই এ নগরের উন্নয়নে সত্যিকারের কোনো পরিকল্পনা করেনি।
নয়াদিল্লি: ঐতিহ্য ও চ্যালেঞ্জের সমন্বয়
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ৩ কোটি ২ লাখ মানুষের বসতি। প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাসে নয়াদিল্লি শহর যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি আধুনিক নগর পরিকল্পনার জন্য চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন। পুরোনো অবকাঠামো, যানজট, শিল্প ও কৃষিদূষণ শহরের দৈনন্দিন বাস্তবতা। অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের চাপ এবং নগরের সীমিত জমি নয়াদিল্লিকে টেকসই নগরায়ণের জন্য কঠিন পরিস্থিতিতে রাখছে।
সাংহাই : চীনের অর্থনৈতিক শক্তি
চীনের সাংহাইতে ২ কোটি ৯৬ লাখ । সাংহাইয়ের ইয়াংজি নদীর দক্ষিণ মোহনায় অবস্থিত এ নগর একসময় ছিল জেলেদের গ্রাম। আজ এটি চীনের বৃহত্তম নগর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ও বিদেশি নাগরিকরা সাংহাইয়ে বসতি স্থাপন করছেন, যার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কায়রো: মিশরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভরকেন্দ্র
মিশরের রাজধানী কায়রো আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান কেন্দ্র। এখানে ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ বসবাস করছেন। ইতিহাস, পিরামিড এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কায়রোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, মিশরের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ কায়রোতে বসবাস করেন। দেশটির বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার প্রধান কার্যালয় কায়রোতে অবস্থিত।
সিউল: উদ্ভাবন ও উচ্চ জীবনমানের কেন্দ্র
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলও ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিচ্ছে। এটি জাতিসংঘ প্রকাশিত ২০২৫ সালের শীর্ষ ১০ মেগা সিটির তালিকায় সবার শেষে রয়েছে। সিউল দেখিয়েছে, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির দেশ নয়, উন্নত অর্থনীতির দেশেও মেগা সিটি গড়ে উঠতে পারে। স্থিতিশীল বৃদ্ধি, উদ্ভাবন এবং কার্যকর নগর পরিকল্পনা সিউলের মডেল। শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চ জীবনমানের কারণে সিউল বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
গুয়াংজু: চীনের অভিবাসীপ্রবাহের কেন্দ্র
সাংহাইয়ের পরই সবচেয়ে জনবহুল মেগা সিটির তালিকায় ৬ নম্বরে রয়েছে চীনের গুয়াংজু নগর। সেখানে ২ কোটি ৭৬ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এটি চীনের তৃতীয় বৃহৎ নগরী। গুয়াংজু ও এর আশপাশের অঞ্চল ব্যাপকভাবে অভিবাসীপ্রবাহের জন্য পরিচিত।
গুয়াংজুর অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে, যে কারণে সেখানে শ্রমের উচ্চ চাহিদা রয়েছে। শ্রমের এ চাহিদা মেটাতেই ফ্লোটিং পপুলেশন গুয়াংজুতে ভিড় করে।
গুয়াংজুতে ফ্লোটিং পপুলেশন বছরে ছয় মাসের জন্য অন্তত তিন কোটি মানুষকে শহরে নিয়ে আসে।
ঢাকা: এশিয়ার নতুন জায়ান্ট
জাকার্তার ঠিক পরেই রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। গত ২৫ বছরে ঢাকা এমন বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে, যা পৃথিবীর অন্যান্য মেগা সিটির তুলনায় সবচেয়ে দ্রুত। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকা জাকার্তাকেও ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরে পরিণত হবে। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণও অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। গ্রামীণ ও উপনগর এলাকার মানুষ শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার জন্য ঢাকায় ঢুকছেন। কিন্তু এই দ্রুত বৃদ্ধির ফলে শহরের অবকাঠামো, স্যানিটেশন, গণপরিবহন ও বাসস্থান ব্যবস্থা ক্রমশ চাপে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর পরিকল্পনা ও টেকসই অবকাঠামো ছাড়া এ জনসংখ্যা চাপ দীর্ঘমেয়াদে নগরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
কলকাতা: ইতিহাস ও আধুনিকতার সমন্বয়
ভারতের কলকাতা শহরে ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ বসবাস করছেন। শহরমুখী জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে কলকাতায় নাগরিক সেবা, আবাসন ও পরিবহন ব্যবস্থায় চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে কলকাতা জনবহুল নগরের তালিকায় ৫ নম্বরে ছিল। এখন কয়েক ধাপ নেমে ৯ নম্বরে গেছে। ২০৫০ সালে আরও এক ধাপ নেমে ১০ নম্বরে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন