মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২
মুফতি রুহুল আমিন
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ০৮:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরকালে পশুপাখির বিচার

পরকালে পশুপাখির বিচার

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীর জীবন দিয়েছেন অল্প সময়ের জন্য। পৃথিবীর জীবন একসময় শেষ হয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে পরকালের জীবন। তবে পৃথিবীর জীবনে যারা ভালো কাজ করবে, পরকালের জীবনে তারা সুফল ভোগ করবে। আর যারা পৃথিবীর জীবনে মন্দ কাজ করবে, পরকালের জীবনে তারা শাস্তি ভোগ করবে। পৃথিবীতে যেমন মানুষ আছে, তেমনি আছে অসংখ্য জাত ও প্রজাতির পশুপাখি। মানুষের কল্যাণে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগৎ। পৃথিবীতে আল্লাহর কোনো সৃষ্টিই অনর্থক নয়। পাখিরা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, দল বেঁধে আকাশে ঘুরে বেড়ায়, কিচিরমিচির-কলকাকলিতে মানুষকে আনন্দে মোহিত করে। রাতের অন্ধকারে আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কুকুর পাহারা দেয় মনিবের বাসগৃহ, রক্ষা করে অসাধু লোকের কুকর্ম থেকে। শিকারি কুকুর এনে দেয় উপাদেয় খাদ্য, গোয়েন্দা কুকুর সাহায্য করে অপরাধী শনাক্ত করতে। উট-ঘোড়া-হাতি দুর্গম মরু-পাহাড়ি পথে বাহন হিসেবে উপকার করে। কৃষিকাজে অবদান রাখে গরু ও মহিষ। বিড়াল বন্ধ করে ইঁদুরের উপদ্রব। এভাবে অসংখ্য পশুপাখি আমাদের যাপিত জীবনে জড়িয়ে আছে আত্মার আত্মীয়ের মতো। তবে মানুষের মতো প্রাণীদের মধ্যেও আছে ভালো-মন্দের অনুশীলন। অনেক পশুপাখি অন্য পশুপাখির ওপর জুলুম-অত্যাচার করে। পরকালে যেমন মানুষের বিচার হবে, তেমনি অত্যাচারী প্রাণীদেরও বিচার হবে।

পৃথিবীর জীবন শেষ হলেই শুরু হবে পরকালের জীবন। পৃথিবীর জীবনের পাপ-পুণ্যের হিসাব চুকিয়ে প্রবেশ করতে হবে পরকালীন জীবনের জগতে। হাশরের মাঠে প্রত্যেকের আমল অনুপাতে প্রতিদান দেওয়া হবে। মানুষ ও জিন জাতির মতো অন্যান্য জীবজন্তুকেও সেখানে একত্র করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দুই ডানাযোগে উড়ে বেড়ায় তারা সবাই তোমাদের মতোই একেকটি শ্রেণি। আমি কোনো কিছু লিখতে ছাড়িনি। অতঃপর সবাই স্বীয় প্রতিপালকের কাছে সমবেত হবে।’ (সুরা আনআম: ৩৮)। মহান আল্লাহর জন্য কোনো কিছুই কঠিন নয়। সবই তার জন্য সমান সহজ। মানুষকে যেমন তিনি একত্র করতে পারবেন, তেমনি পশুপাখিদেরও পারবেন একত্র করতে। বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত কাতাদা (রহ.)-এর ভাষ্যমতে, সবকিছু একত্র করা হবে, এমনকি বিচারের জন্য মাছি পর্যন্ত একত্র করা হবে। কোরআনে এসেছে, ‘তার এক নিদর্শন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন ইচ্ছা, এগুলোকে একত্র করতে সক্ষম।’ (সুরা শুরা: ২৯)। এসব আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কেয়ামতের দিন জীবজন্তুদেরও হাশর হবে। তাদেরও একত্র করা হবে। তবে মানুষ ও তাদের মধ্যকার পার্থক্য হলো, মানুষের মতো তাদের থেকে কুফরি-শিরক ও ইমান-আমলের হিসাব নেওয়া হবে না।

এ ছাড়া মানুষের জান্নাত-জাহান্নাম আছে, জীবজন্তুদের তা নেই। তবে দুনিয়ায় শক্তিশালী কোনো পশু অন্য কোনো দুর্বল পশুকে অন্যায়ভাবে আঘাত করে থাকলে হাশরের দিন দুর্বল পশুটিকে সুযোগ দেওয়া হবে অন্যটির কাছ থেকে সমান প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই প্রত্যেক পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করে দেবে। (অন্যথায় কেয়ামতের দিন তা পরিশোধ করা হবে) এমনকি একটি শিংবিশিষ্ট ছাগল যদি দুনিয়ায় কোনো শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতা মেরে থাকে, তাহলে তার থেকে শিংবিহীন ছাগলের জন্য প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’ (মুসলিম: ২৫৮২)। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.) দুটি বকরিকে গুঁতোগুঁতি করতে দেখে বললেন, হে আবু জর, তুমি কি জানো, কেন তারা গুঁতোগুঁতি করছে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, কিন্তু আল্লাহ জানেন। তিনি অচিরেই কেয়ামতের দিন এর বিচার করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ৫/১৬২, হাদিস: ২১৭৬৮)। এসব হাদিসের ব্যাখ্যায় হাদিস শাস্ত্রের ভাষ্যকাররা বলেছেন, কেয়ামতের দিন জীবজন্তুদের একত্র করার প্রসঙ্গে এ হাদিসগুলোতে নির্দেশনা রয়েছে। তাদেরও সেভাবেই ওঠানো হবে, যেভাবে ওঠানো হবে মুকাল্লাফ তথা শরিয়ত পালনে আদিষ্ট নরনারী, শিশু, মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় মানুষ এবং যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি তাদের।

এ ছাড়া হাদিসগুলোতে মানুষের জন্য আরও একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সেটি হলো, যখন শরিয়ত পালনে আদিষ্ট নয় এমন সৃষ্টজীবদের জুলুম মাফ করা হবে না, তাহলে কীভাবে শরিয়ত পালনে আদিষ্ট মানুষের জুলুমকে ক্ষমা করা হবে? তাই জালেম-জুলুম থেকে তওবা করে এর ক্ষতিপূরণ না করলে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।

পারস্পরিক নির্যাতনের বিচারের পর সব জীবজন্তু মাটিতে মিশে যাবে। কাফের ব্যক্তি তখন আফসোস আর আক্ষেপ করে বলবে আমিও যদি মাটি হয়ে যেতাম! তাহলে তো আমার শাস্তির সম্মুখীন হওয়া লাগত না। মহানবী (সা.) বলেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা চতুষ্পদ জন্তু, পাখি ও মানুষ সব সৃষ্টজীব একত্র করবেন। পশুপাখিদের বলবেন, তোমরা মাটি হয়ে যাও। তখন কাফের ব্যক্তি বলবে, হায় আমিও যদি মাটি হয়ে যেতাম!’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহা: ৪/৬০৭)।

এ কথা তো স্পষ্ট যে, জীবজন্তু শরিয়তের কোনো বিধান পালনে আদিষ্ট নয়; বিধান পালনে আদিষ্ট হলো মানুষ ও জিন জাতি। তাহলে জীবজন্তুদের শাস্তি হবে কেন? এজন্য কোনো আলেম জীবজন্তুদের ব্যাপারে বলেছেন, তাদের বিচারের জন্য হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে না। তাদের বক্তব্য হলো, হাদিসে যেসব জীবজন্তু একে অন্য থেকে বদলা গ্রহণ করবে তা বলা হয়েছে, এটা একটা দৃষ্টান্ত। হিসাব-নিকাশ ও বদলা গ্রহণের ভয়াবহতা এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য। অবশ্য এ বিষয়টি খণ্ডন করে হাদিসশাস্ত্রের অমর ভাষ্যকার ইমাম নববি (রহ.) বলেছেন, যেখানে পবিত্র কোরআনে ‘যখন বন্য পশুরা একত্র হয়ে যাবে’—এর মতো স্পষ্ট আয়াত আছে সেখানে তাদের একত্র করা হবে না বলে ব্যাখ্যা করার কোনো মানে হয় না। তাই আয়াত তার বাহ্যিক অর্থেই প্রয়োগ হবে। অর্থাৎ জীবজন্তুদের পারস্পরিক বিচারের জন্য একত্র করা হবে এটাই স্পষ্ট। (শরহুন নববি আলা মুসলিম: ১৬/১৩৬)। তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে মুফতি শফি (রহ.)-এর উত্তর এভাবে দিয়েছেন যে, ‘জীবজন্তুদের পারস্পরিক নির্যাতনের প্রতিশোধ আদিষ্ট হওয়ার কারণে নয়; বরং মহান আল্লাহর চূড়ান্ত ইনসাফ ও সুবিচারের কারণে। তবে তাদের অন্য কোনো কাজের হিসাব নেওয়া হবে না।’ (তাফসিরে মায়ারিফুল কোরআন)।

তবে মানুষের উচিত নয় অকারণে পশুপাখিকে কষ্ট দেওয়া। প্রাণীকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি অনেক মন্দ। পৃথিবীতে কোনোভাবে পার পেয়ে গেলে পরকালে ছাড় পাওয়া যাবে না। প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা রাখলে মিলবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার। অযথা কষ্ট দিলে অবশ্যই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে জাহান্নামের আগুনে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চড়ুইকে অযথা হত্যা করল, তা কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার কাছে উঁচু স্বরে ফরিয়াদ করে বলবে, ইয়া আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা অযথা করেছিল, সে কোনো লাভের জন্য আমাকে হত্যা করেনি।’ (নাসায়ি, হাদিস: ৪৪৪৬)। বিড়ালকে কষ্ট দেওয়ার কারণে এক মহিলাকে জাহান্নামে যেতে হয়েছিল। নবীজি (সা.) বলেন, ‘এক নারীকে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়েছিল। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। ওই অবস্থায় বিড়ালটি মারা যায়। মহিলাটি ওই কারণে জাহান্নামে গেল। কেননা সে বিড়ালটিকে খাবার-পানীয় কিছুই দেয়নি এবং ছেড়েও দেয়নি যাতে সে জমিনের পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত।’ (বোখারি, হাদিস: ৩৪৮২)।

ইসলামে প্রাণীর প্রতি মমতা প্রদর্শনের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রতি সহনশীল আচরণ ও মমতা দেখিয়ে একজনের বেহেশতে যাওয়ার ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। ঘটনাটি হলো, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এক ব্যক্তির ভীষণ পিপাসা লাগে। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে ওপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহতায়ালা তার আচরণ কবুল করেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দেন। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করলেও রয়েছে পুণ্য। (বোখারি, হাদিস: ২৩৬৩)।

মহান প্রভুর কাছে প্রার্থনা, যাপিত জীবনে ছোট-বড় সব ধরনের পশুপাখির প্রতি যেন সদয় থাকতে পারি।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জে বিএনপির ভরসা মমিনুল হক

৪৫ রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বহালসহ ৮ দাবিতে আলটিমেটাম

বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের ‘সুখবর’ দিলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা শিগগিরই, যেসব আসনে লড়তে পারেন শীর্ষ নেতারা

যে জেলার কোনো আসনেই প্রার্থী দেয়নি বিএনপি

সেই প্রিয়াঙ্কাতেই আস্থা বিএনপির

ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ‘মায়ের ডাকের’ তুলি

কুমিল্লার ৯ আসনে যাদের পেল বিএনপি

সৌদিতে বসে সুখবর পেলেন বিএনপির যে নেতা

১০

যেসব আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি

১১

নতুন-পুরাতন মিলিয়ে রাজশাহীর আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থী হলেন যারা

১২

চমক দিয়ে বরিশালের ১৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা

১৩

দিনাজপুর-৬ আসনে ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন ডা. জাহিদ

১৪

জোট-সঙ্গীদের জন্য যেসব আসন রাখল বিএনপি

১৫

কুড়িগ্রামের ৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেন যারা

১৬

জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ হলেন আশরাফুল

১৭

খুলনার ৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা

১৮

নারায়ণগঞ্জের ৪টি আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা

১৯

রংপুরের ছয় আসনে বিএনপির প্রার্থী হলেন যারা

২০
X