মাওলানা আব্দুর রহমান
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৫, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাপের ভারে প্রকৃতিতে বিপর্যয় ঘটে

পাপের ভারে প্রকৃতিতে বিপর্যয় ঘটে

পৃথিবীর বুকে যত বিপর্যয় ও দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, তার জন্য প্রধানত দায়ী মানুষের সীমাহীন পাপ ও সীমালঙ্ঘন। প্রকৃতিতে মানুষের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়, তেমনি নৈতিক অধঃপতন ও গুনাহের কারণে সমাজের সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হয়। ভালো কাজের সুফল যেভাবে আমরা ভোগ করি, একইভাবে মন্দ কাজের ফলে আমাদের ভুগতে হয় নানা দুর্ভোগ। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কিংবা বৈশ্বিক পর্যায়ের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ সব বিপর্যয়ের জন্য মানুষের কৃতকর্মকেই দায়ী করেছেন—সেটা হোক জাগতিক অন্যায়-অনাচার কিংবা গুনাহ-পাপাচার। আল্লাহ মানুষকে সবসময় পাকড়াও করেন না। তাকে শোধরানোর সুযোগ দেন। তবে তারা যখন সীমালঙ্ঘন করে, তখনই তিনি পাকড়াও করেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে, তা তো তোমাদের কর্মফল। আমি তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে থাকি।’ (সুরা শুআরা, আয়াত: ৩০)। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেন এবং আখেরাতের মহা শাস্তির ব্যাপারে সাবধান করেন, যাতে তারা জুলুম ও পাপাচার থেকে বিরত থাকতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের কারণেই বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের নিজেদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৪১)। মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ছোট-বড় যত দুর্ভোগ বা হয়রানি বান্দার ওপর আপতিত হয় সবই নিজ কর্মদোষে। আর অধিকাংশই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।’ (বোখারি)।

আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হয়ে আমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে। যেমন, সাবাবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন। দুটি উদ্যান, একটি ছিল ডানদিকে অন্যটি বামদিকে। (তাদের বলা হয়েছিল) তোমরা তোমাদের রবের দেওয়া খাদ্য খাও এবং তার শুকরিয়া আদায় করো। এটা ছিল উত্তম শহর এবং তোমাদের প্রতিপালক ক্ষমাশীল। এরপর তারা অবাধ্যতা করল। ফলে আমি তাদের প্রতি বাঁধভাঙা বন্যা প্রবাহিত করলাম এবং তাদের উদ্যান দুটি পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটি উদ্যানে—যাতে উদগত হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ। এটা ছিল কুফরের কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’ (সুরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭)। ভূমিকম্প সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৬৫)। তাফসিরবিদদের মতে, এর ব্যাখ্যা হলো ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের প্রকৃত রূপ কতটা ভয়াবহ, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে জমিন এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে পর্বতমালা, অতঃপর তা পর্যবসিত হবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায়।’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ৪-৬)। তা ছাড়া মহান আল্লাহ ভূমিকম্পের মাধ্যমেই কেয়ামত সংঘটিত করবেন। এ ব্যাপারে কোরআনে সুরা জিলজাল নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন। জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা সম্পর্কেও মহান আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন। হজরত নুহ (আ.) তার জাতিকে আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানির শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। অবশেষে আল্লাহর আজাব আসে। এক ভয়ংকর প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস তার জাতির অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন নুহ (আ.)-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার (নুহের) বংশধরদের অবশিষ্ট রেখেছি বংশপরম্পরায়।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ৭৭)।

হজরত নুহ (আ.)-এর কওম আল্লাহর হুকুম অমান্য করে দেব-দেবীর পূজা করত। তারা আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের প্রতি মহাপ্লাবন নাজিল করেন এবং সেই প্লাবনে নিমজ্জিত করে তাদের ধ্বংস করে দেন। কিন্তু নুহ (আ.)-এর অল্পসংখ্যক অনুসারীকে আল্লাহ মহাপ্লাবন থেকে হেফাজত করেন। হজরত হুদ (আ.)-এর সম্প্রদায়ও একই অপরাধে অপরাধী ছিল। তাদের আল্লাহতায়ালা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস করে দেন। হজরত শোয়াইব (আ.)-এর গোত্র ওজনে কম দিত। এ ব্যাপারে তারা সীমালঙ্ঘন করলে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দেন। হজরত লুত (আ.)-এর গোত্র সমকামিতায় লিপ্ত হতো। তারা যখন এই অপরাধের চরম সীমায় পৌঁছে গেল, তখন তাদের ভূমিকম্প ও পাথর বর্ষণে ধ্বংস করে দেন এবং নিরপরাধীদের রক্ষা করেন। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যাদের আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন অপরাধের কারণে ধ্বংস করে দেন। তবে এ উম্মতে মুহাম্মদি আজাব-গজব দ্বারা সমূলে ধ্বংস হবে না, এটা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়ার ফল এবং উম্মতে মুহাম্মদির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সময়ে সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদাপদ দিয়ে সাবধান করা হবে, যা আমরা মাঝেমধ্যে লক্ষ করছি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি দেখে না যে, তারা প্রতি বছর দুয়েকবার বিপর্যস্ত হয়? এরপরও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৬)। হাদিসে শরিফে আছে, পিতা-মাতা সন্তানকে যত ভালোবাসে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তাই কখনো কখনো মানুষের কর্মদোষে বিপদাপদ সংঘটিত হওয়া সংগত হলেও আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে বান্দাকে ক্ষমা করে দেন এবং বিপদ সংঘটিত করেন না। তবে ক্ষমার অযোগ্য হলে বিপদ সংঘটিত করেন। এটা সার্বভৌম ক্ষমতাধর আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাধীন।

আমাদের জানা উচিত, এ প্রকৃতির পেছনে একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি তা নিয়ন্ত্রণ করেন। আকাশমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা আছে সবই তার আজ্ঞাবহ। যখনই তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন, ‘কুন—হও’ তখন সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যায়। (সুরা ইয়াসিন: আয়াত ৮২)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে, তার নির্দেশে বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং তার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৬৪)। তাই প্লেগ, কলেরা, করোনা আল্লাহর নির্দেশেই সংঘটিত হয়েছে, তবে তা বান্দার সীমা লঙ্ঘনজনিত কর্মের জন্য সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করি না যতক্ষণ না তারা নিজে নিজের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ: আয়াত ১১)। সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের কর্মদোষে বিভিন্ন পাপাচারে সীমালঙ্ঘনের ফলে জলে-স্থলে বিপদাপদ নাজিল হয়। তাইতো আমাদের অতীতের কৃতকর্মের জন্য তওবা করে সংশোধন হওয়া জরুরি এবং ভবিষ্যতে যেন আমাদের মাধ্যমে এমন কোনো পাপাচার না হয়, যার জন্য আল্লাহতায়ালার ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কারণ সীমালঙ্ঘিত হলে যে কোনো সময় আমাদের ওপরও আল্লাহতায়ালার কঠিন আজাব আসতে পারে। আর বিচার দিবসের কাঠগড়ায় তো আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের বিপদাপদ মুক্ত করুন এবং ক্ষমা করে দিন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় নেই ডাম্পিং স্টেশন

ঈদে হাট কাঁপাতে আসছে ‘লালু সর্দার’ ও ‘কালিয়া’

ছুটির দিনে ঘুরতে গিয়ে খুন হলেন আব্দুল্লাহ

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যুবকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা

চরে হঠাৎ জোয়ারের পানি, মৃত অবস্থায় ৩৪ গরু উদ্ধার

মার্কিন মালিকানায় গেল দ্য টেলিগ্রাফ

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১১ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

ঈদুল আজহা : ট্রেনের ৩ জুনের টিকিট বিক্রি আজ

গাজার উত্তরে এখনো খাবার যায়নি, আরও মৃত্যু ৭৬

১০

২৪ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

২৪ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১২

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতারণার ফাঁদ, অতঃপর

১৩

‘যারা আজ সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, তারাই মাকে দূরে রাখতে চায়’

১৪

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

১৫

চবি তেপান্তর সাহিত্য সভার নেতৃত্বে আবদুল মোমেন-রিয়াদ উদ্দিন

১৬

বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কদের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৪

১৭

সৈকতে পড়ে আছে মৃত ডলফিন, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

১৮

পতেঙ্গা সৈকতে গোলাগুলি, ঢাকাইয়া আকবরসহ গুলিবিদ্ধ ২

১৯

কারাবন্দি সোহাগের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

২০
X