ব্রিটিশ নির্বাচনে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে পার্লামেন্টের ৪১২টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ লেবার পার্টি। জয় যে তাদের করায়ত্ত হবে আর কনজারভেটিভরা হেরে যাবে—এমন পূর্বাভাস সাধারণ নির্বাচনের আগেই সংবাদমাধ্যম ব্রিটিশ ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু জয় যে এতটা ব্যবধানের হবে, সেটা হয়তো কেউই কল্পনা করেনি। লেবার পার্টিকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে উদারনৈতিক, মধ্যপন্থি, বামপন্থি দল হিসেবে মনে করা হয়।
দলটির ভেতর কখনো কখনো বামপন্থিদের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তারা দলটির নেতৃত্বেও চলে আসে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি যখন রক্ষণশীল পার্টির দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে টনি ব্লেয়ারকে প্রধানমন্ত্রী করে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন ব্রিটিশরা লেবার পার্টির কাছ থেকে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিল, যিনি কি না রক্ষণশীলদের চেয়েও অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিলেন। ইরাক যুদ্ধের সময়, কিংবা মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে টনি ব্লেয়ার ছিলেন মার্কিন নীতির কড়া সমর্থক। টনি ব্লেয়ারকে বলা হতো তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পোষ্য ও পালিত।
এমন অসম্মানজনক উপাধি লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রীর কপালে জুটলেও টনি ব্লেয়ার তার মার্কিনঘেঁষা অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেনি। টনির পতনের পর ২০১৫-এর সেপ্টেম্বরে লেবার পার্টির নেতৃত্বে চলে আসে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে একদল বামপন্থি। এবারের নির্বাচনে যে ভোট লেবার পার্টি পেয়েছে (প্রাপ্ত ভোটের ৩৪ শতাংশের কিছু বেশি) তা জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের লেবার পার্টির ভোটের চেয়ে কম, ২০১৯-এ প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে খুব বেশি নয়। সবাইকে অবাক করে, দলছাড়া জেরেমি করবিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতে এসেছেন ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে। করবিনের সমর্থক যেসব লেবার এমপি দল ছাড়েননি, তারা ভোটারদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। দলের ডানপন্থি ঝোঁকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এসব ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি সহসাই তাদের পুরোনো পথ পরিত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সমর্থক হয়ে যাবেন—এমনটা ভাবা দুষ্কর। করবিন ছিলেন লেবার পার্টির কট্টর বামপন্থিদের একজন। যিনি পুঁজিবাদবিরোধী একজন রাজনীতিক; যার চিন্তায় ছিল ব্রিটেনকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সরকার উপহার দেওয়া। তার ছায়া মন্ত্রিপরিষদের অর্থমন্ত্রী জন ম্যাকডোনেলকে কেউ কেউ কার্ল মার্ক্সের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত রাজনীতিক মনে করতেন। জেরেমি করবিনকে ছেড়ে বা বের করে, ডানপন্থায় ঝুঁকে কিয়ার স্টারমার যে লেবার পার্টির জন্ম দিয়েছেন, সেই লেবার পার্টি ব্রিটিশ জনগণকে একটি স্থিতিশীল ন্যায়পরায়ণ সমাজ ও অর্থনীতি পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
গত ৯ বছরের শাসনামলে রক্ষণশীলরা পাঁচবার নেতৃত্ব পরিবর্তন করেছে। বিগত সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে ব্রিটেন অব্যাহতভাবে দুর্বল হয়েছে। গত কয়েক দশকে ব্রিটিশদের মার্কিনিদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। তা অর্থনীতি ইস্যু থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ইস্যু পর্যন্ত, সর্বক্ষেত্রে। বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রিটেনের যে আলাদা স্বকীয়তা ছিল, তা ম্লান হয়ে গেছে অব্যাহতভাবে সব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় কিয়ার স্টারমার বারবার উচ্চারণ করেছেন চেঞ্জ অর্থাৎ পরিবর্তনের কথা। এই পরিবর্তন কার হবে? ব্রিটেনের বামপন্থি দলগুলো ক্ষুদ্র হলেও তাদের রাজনীতিতে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বিবৃতির প্রভাব রয়েছে। এরই মধ্যে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে, ‘কিয়ার স্টারমার পরিবর্তন এনেছেন ধনীদের রক্ষাকর্তার আসনে। ধনীদের রক্ষার্থে প্রহরীর পরিবর্তন এসেছে।’
কিয়ার স্টারমার ১১ মাসের মতো জেরেমি করবিনের ছায়া মন্ত্রিসভায় অভিবাসী মন্ত্রীর পদে ছিলেন। নির্বাচনের আগে অভিবাসীদের নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলেছে, যা লেবার পার্টির দীর্ঘদিনের রাজনীতির চর্চার ঠিক বিপরীত। কাশ্মীর প্রশ্নে জেরেমি করবিন সবসময়ই বলে এসেছেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কাশ্মীরের জনগণ। আর নির্বাচনের সময়ই কাশ্মীর প্রশ্নে কিয়ার স্টারমার বিজেপির অবস্থানের পক্ষেই কথা বলেছেন।
একটা স্পষ্ট বিভাজন কিয়ার স্টারমারের লেবার দলের ভেতর পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্টারমার যে লেবার পার্টির সর্বজন সমর্থিত নেতা নন, এমনটা প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছে। স্টারমারের মন্ত্রিসভার ৪৬ শতাংশ এসেছে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। যেখানে ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভায় এ হার ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভায় উচ্চবিত্তের প্রাধান্যই বেশি ছিল। সে ক্ষেত্রে ধনীদের ছাড় দেওয়ার যে প্রবণতা, সেই প্রবণতায় একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি স্টারমারের সঙ্গে তার মন্ত্রিসভার ঘটে যেতে পারে। ইউরোপের ঘাড়ের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধ চেপে বসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা ইউরোপকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ করা মানে রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করা, আবার এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াও দুষ্কর হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি নৃশংসতাকে সমর্থন দেওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে অব্যাহত বিক্ষোভ সংকটে ফেলে দিয়েছে এসব দেশের শাসকদের। কেন ইউরোপ-আমেরিকার শাসকরা ইসরায়েলের প্রতি এত সদয়? এমন কারণ খুঁজতে গিয়ে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এসব রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্বাচনে জিতে আসার জন্য তহবিলের উৎস সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, নির্বাচনে জিতে আসতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হয়। আর এ তহবিল আসে ইউরোপ-আমেরিকার ধনীদের কাছ থেকে। ধনীরা যে দলকে বেশি অর্থ দেয় তারাই প্রচারণায় এগিয়ে যায়। জয়লাভ করে। ধনীদের বড় অংশ ইহুদি বংশোদ্ভূত। তাই ইউরোপ-আমেরিকার শাসকরা ইসরায়েলের প্রতি এত সদয় থাকে সবসময়।
এই তথ্যে ইহুদি-বিদ্বেষ আছে, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু ভয়াবহ সত্য আছে, সেটি হলো—টাকার দাসত্বে বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত। যে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্রের কথা এসব রাষ্ট্রের শাসকরা বলে থাকেন, তা যে সত্যি নয় তাই ফুটে এসেছে এমন তথ্যে; ইউরোপ-আমেরিকার শাসকদের কর্মকাণ্ডে।
ব্রিটিশ লেবার পার্টি মধ্য ও মধ্য-বামপন্থি দল বলেই বিশ্বে পরিচিত। আগামী দিনগুলোতে একজন ডানপন্থার ঝোঁকে ঝুঁকে থাকা প্রধানমন্ত্রী নিয়ে সংকটে ঘিরে থাকা ব্রিটেন কেমন করে পথ চলে, তা দেখার অপেক্ষায় সচেতন বিশ্ববাসী।
লেখক: কলাম লেখক ও সংগঠক