রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতি ও দুর্জন সর্বদা পরিত্যাজ্য

দুর্নীতি ও দুর্জন সর্বদা পরিত্যাজ্য

ছাত্রাবস্থায় ভাবসম্প্রসারণ পড়েছি, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’। কারণ বিদ্যা ও চরিত্র এ দুটি মানবজীবনে মূল্যবান সম্পদ। তাই বিদ্বানের সঙ্গ কল্যাণকর কিন্তু বিদ্বান অথচ চরিত্রহীন এমন ব্যক্তির সঙ্গ কখনো সমাজ ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তাদের সঙ্গ সর্বদাই পরিত্যাজ্য। এ ধরনের বিদ্বানরা তাদের অসৎ চরিত্রের মাধ্যমে সজ্ঞানে দেশ, জাতি ও সমাজের ভয়ানক ক্ষতি করেন। বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র সম্মানিত। কিন্তু দুর্জন প্রকৃতির লোক বিদ্বান হলেও সে সমাজের দুশমন। সবাই তাকে ঘৃণা করে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হতে পারে, ‘দুর্জন আর দুর্নীতিবাজ’ বিদ্বান হলেও তাদের পরিত্যাজ্য করা উচিত। কারণ দুর্নীতির দুষ্টক্ষত সমাজের অগ্রগতি, মানুষের প্রত্যাশা স্বপ্নকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত করে। তা ছাড়া বাস্তবে দেশের অধিকাংশ মানুষই সৎ। কেবল কিছু কিছু সরকারি, আধাসরকারি সংস্থা, সেবাধর্মী সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে আজকে সরকারে যারা আছেন, বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতিও তির্যক দৃষ্টি পড়ছে, অভিযোগের আঙুল তুলছেন।

মূলত সাম্প্রতিককালে পুলিশের বেনজীর, চট্টগ্রামে পুলিশের এডিসি কামরুল, এনবিআরের মতিউর, মতিউরের দুই স্ত্রী, চার সন্তান, ক্যাশিয়ার, বান্ধবী, ফয়সাল, এনামুল, ইসলাম, পলিটেকনিক শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত চেয়ারম্যান আলী আকবর খান, সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান, নামিদামি বিশ্ববিদ্যাললের সনদ জালকারী প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতু, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী ও দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান মালেক, মিঠু, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে আলোচিত পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক ড্রাইভার আবেদ আলী জীবন, তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আটককৃতদের ছয়জনই সরকারি কর্ম কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে আলোচনা, নিউজ প্রকাশ এবং এ নিয়ে সরকারের দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রহস্য উন্মোচিত হলো সম্প্রতি। প্রশ্নপত্র ফাঁস অব্যাহত থাকায় জাতির বহু মেধাবীর মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, আবার যারা কম মেধাবী অথচ ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত খোদ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্মকর্তা, তিন কর্মচারীসহ ১৭ জনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এ চক্র অন্তত এক যুগ ধরে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার চাকরির ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। আর এ কাজ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রত্যেকেই।

জনগণের সেবার জন্য এবং সরকারের উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নই হচ্ছে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। একইভাবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলায় অন্যান্য বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে সেবাপ্রার্থীদের ঠেকিয়ে, ঠকিয়ে, ফাইল আটকে অবৈধ, অনৈতিক পথে কামাই করছে কোটি কোটি টাকা।

পাকিস্তান আমলও প্রশাসনে দুর্নীতি ছিল। এখন ক্রমাগতভাবে তা বাড়ছে। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি থেকে মুক্তি এবং সৎ পরিশ্রমী ও বিবেকবান আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা। ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন করা একটি দেশের কাছে জনগণের এই দাবি খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। অধিকাংশই সেই মহান লক্ষ্য থেকে প্রশাসন সরে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রেই তারা তাদের ভোগের ভাগ নিশ্চিত করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে, প্রশাসনকে দুর্নীতির যূপকাষ্ঠের দিকে ঠেলে দেয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে রাজনীতিকে, রাজনীতিককে মূলত দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে দুর্নীতির স্বর্ণযুগ ছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়। তখন দুর্নীতিতে রাষ্ট্রকে পরপর পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের তকমা লাগাতে হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়েছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে তাদের স্বামীর হাতে যখন আলাদিনের চেরাগ থাকে তখন স্ত্রীরাও সেই আলোয় আলোকিত হয়। আবার কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত স্ত্রীর বদৌলতে স্বামী আলোকিত হয়।

পুলিশের কিছু সদস্যের কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির কারণে সাধারণ এবং ভুক্তভোগী মানুষ আস্থাহীন। এ ধরনের একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে দুর্নীতির কারণেই। দুর্নীতির সঙ্গে পুলিশ বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ঘোচাতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ অবস্থার অবসান চান সবাই। তাই উপযুক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। ঘুষ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ‘আলোচিত’ ঘটনা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদহারা করানোর জন্য সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ। শুধু ঘুষ নয়, সিরাজের সিংহাসনও তাকে দেওয়া হবে বলে চুক্তি করা হয়। তার ফল শুধু বাংলা কেন, ভারতবাসীও ভোগ করেছে। মীর জাফর ও ক্লাইভও ভোগ করেছেন। মীর জাফর গদিহারা-ইজ্জতহারা হয়ে মরেছেন। আর রবার্ট ক্লাইভকে করতে হয়েছে আত্মহত্যা। কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির খেসারত ব্যক্তির শাস্তিতে শেষ হয় না, তার দায় ভোগ করে দেশ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এমনকি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও চলে যেতে পারে।

ব্যক্তির দুর্নীতি তাই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলে। নীতি নয়, দুর্নীতিই যেহেতু সংক্রামক, সেহেতু দুর্নীতিবাজরা পুরো সমাজকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। ঝুড়ির একটা পচা আম বাকি আম পচিয়ে দিতে যথেষ্ট। এজন্যই দুর্নীতিবাজদের পরিবারে, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুমহলে খুব কম লোককেই পাওয়া যায়, যারা বলতে পারে—তুমি ভালো না, তুমি দুর্নীতিবাজ। দুই-দশ ডজন দুর্নীতিবাজ দমন করা খুবই সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতিবান্ধব এ সংস্কৃতি এই সমাজকে পাল্টাতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস ও কার্যকর উদ্যোগ। নতুবা দুর্নীতিই যদি নীতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এজন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন।

আজ গুটিকয় দুর্নীতিবাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাদের নাটকীয় আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা তো দুর্নীতির সিস্টেমের অংশবিশেষ মাত্র। তাই জনপ্রত্যাশা ও জনগণের মনের আশা পূরণে তাদের কয়েকজনকে ঝেড়ে ফেলে দিলে সিস্টেমের বরং লাভ। ওই স্থানে ফ্রেশ ব্লাডের কর্মকর্তা নিয়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো বা নবায়ন করে নিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘অ্যাপেনডিকস’ ফেলে দিলে শরীর আরও সচল, সবল হয় এবং সক্রিয় ও স্বচ্ছ হবে। দুর্নীতিবাজদের দৌড়ানি দিলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে দুর্নীতির দুষ্টক্ষত থেকে দেশ, রাষ্ট্র, সরকার, মানুষ মুক্তি পাবে। তাই আসুন আমরা সমস্বরে, দৃঢ়কণ্ঠে দুর্নীতিকে না বলি। দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন এবং মোকাবিলা করে আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলাকে সুগম করি। জীবন হোক কুসুমাস্তীর্ণ। সমাজ হোক দুর্নীতিমুক্ত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখি। এ দৃঢ় অঙ্গীকার হোক আমাদের সবার পথ চলার পাথেয়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১২ ঘন্টারও কম সময়ে পরিষ্কার ঢাকা : আসিফ মাহমুদ

২০ লাখ টাকার জুয়েলারিসহ ব্যাগ ছিনিয়ে নিল বানর, অতঃপর...

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে সরে এলো পশ্চিমা দুই দেশে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর স্ত্রী মারা গেছেন

পদ্মা সেতু প্রকল্পের রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লি, ঢাকার অবস্থান কত

ঈদের ছুটিতে সাদা পাথরে পর্যটকের সমাগম

ঢাকায় আজ বৃষ্টি হবে কিনা, জানাল আবহাওয়া অফিস

যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ, শহরজুড়ে আতঙ্ক

আধিপত্য নিয়ে আ.লীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষ, ওসিসহ আহত ৬০

১০

তিন পুরুষ মিলে ঈদের নামাজ পড়েছেন মুশফিক

১১

গাজায় একই পরিবারের ১৬ সদস্যসহ নিহত ৭৫

১২

০৮ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

০৮ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

মাস্কের স্টারলিংক নিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে এলো ভয়ংকর তথ্য

১৫

৩ বছরের সাজা এড়াতে ৫ বছর পলাতক, অবশেষে গ্রেপ্তার

১৬

বের হন কোরবানির মাংস দিতে, ফেরেন লাশ হয়ে

১৭

শহীদ সাজিদের পরিবারের সঙ্গে জবি শিবিরের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়  

১৮

খালেদা জিয়া ভালো আছেন, সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন : মির্জা ফখরুল

১৯

সরকারি বাঙলা কলেজের মানবিক উদ্যোগ  

২০
X