২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ এক কৃষক পরিবারের ৯ সন্তানের একজন। সাঈদ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এ শিক্ষার্থী স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন সরকারি চাকরি পাবেন। চাকরির সুবাদে পরিবারের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হবে। অভাব দূরের পাশাপাশি পরিবারকে একটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যাবে। কিন্তু যখন সরকারের নতুন কোটাব্যবস্থায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ (১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করেছিলেন যারা) বংশধরদের জন্য এ চাকরির ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়, তখন তার দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
সাঈদ ভালো করেই জানতেন যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ১৮ মিলিয়ন বেকার যুবক রয়েছে। আর তিনিও স্নাতক হওয়ার পর এই জঘন্য পরিসংখ্যানের অংশ হতে চাননি। তাই তিনি কোটা পদ্ধতির সংস্কারের জন্য দেশব্যাপী আন্দোলনের একজন প্রধান সমন্বয়কারী হন। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন’।
প্রতিবাদ চলাকালে সাঈদ পুলিশ থেকে মাত্র ১৫ মিটার দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ যখন তার বুকে গুলি চালায়, তিনি দুহাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
এই নির্মম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও অনলাইনে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুনে সারা দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, অভিভাবক এবং রিকশাচালক সাঈদের মৃত্যুতে ক্ষোভ ও শোকে সংহতি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ও সশস্ত্র বাহিনীর হাতে বিক্ষোভকারীরা যারা মারা যায়, তারা সংখ্যায় কম নয়। অবশেষে তাদের দুর্বার প্রচেষ্টা এবং তারা যে বাস্তব ঝুঁকি নিয়েছিল, তা বৃথা যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের ৭ শতাংশ চাকরি বরাদ্দ রেখে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে রায় দেন দেশটির হাইকোর্ট। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। কোটা সংস্কারে ব্যাপক ছাড়ও অস্থিরতা অবসান করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো সহিংসতা ছাত্র আন্দোলন আমূল বদলে দেয়। পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের শুধু কোটা পদ্ধতি ঠিক করাই নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু অর্জনের দিকে ঠেলে দেয়। তারা আসলে বাস্তবিক ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন চেয়েছিল। একটি নতুন সরকার চায় এবং তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়।
আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে প্রতিনিধিত্ব করে। শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে, ছাত্র আন্দোলনের এ সংকল্প তিনি ভাঙতে পারবেন না। তাকে পদত্যাগের পাশাপাশি দ্রুত সামরিক বিমানে দেশত্যাগ করতে হয়।
আবু সাঈদের মতো আদর্শবাদী যুবকদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র আন্দোলন এমন এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করতে সক্ষম হয়, যিনি ১৫ বছর ধরে লৌহ দণ্ড দিয়ে দেশ শাসন করেন। এই আয়রন লেডিকেই আবার মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দেশ থেকে পালাতে হলো। পরিস্থিতি তাকে একবার পেছনে ফিরে তাকানোর সময়ও দেয়নি। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ এই অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে যে আর সন্তুষ্ট নয়—এটা তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ ও একই সঙ্গে এ আন্দোলনের সাফল্য।
বস্তুত গত এক দশকে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু অর্থনীতির সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ধরে নিয়েছিল যে, এ সাফল্য জনগণের নাগরিক অধিকার এবং তাদের স্বাধীনতাকে পদদলিত করা; বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা এবং দেশের আইনের প্রতি কোনো সম্মান বা বিবেচনা না করেই শাসন করার দায়মুক্তি দেবে। এমনকি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক নিয়ম ও ধারাগুলোকেও।
প্রকৃতপক্ষে গত ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই গর্ব করে বলেছেন যে, তিনি কীভাবে স্বল্পোন্নত দেশের দারিদ্র্যকে অর্ধেকে কমিয়ে এনেছেন। আর দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ব্যবহার করেছেন দেশের বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টদের মনোযোগ সরিয়ে রাখতে; যাদের মধ্যে কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কাউকে ভরা হয়েছে জেলে। আবার সরকারকে সমালোচনায় দায়ে কঠোর অপরাধমূলক কর্মে লিপ্ত—এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে; তাদের কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, কাউকে করা হয়েছে গুম।
কিন্তু হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন, দুর্নীতি এবং বৈষম্যকে ঢাকা দিতে বা বৈধতা দিতে সার্বক্ষণিক যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলা হতো, সেই প্রয়াস ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গত এক দশকে বা তারও বেশি সময়ে বেড়ে উঠতে থাকা নতুন একটি প্রজন্মের সামনে দেশকে ‘উন্নতিশীল সমৃদ্ধ দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও দেশের মানুষের মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির সব বয়সী মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর করা বর্বরতা থেকে শুরু করে যে কোনো সময়ের শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে—এটা সত্য। আবার সেসব সময়ে সংস্কার বা প্রতিকারের ব্যাপারে দুটি প্রবণতাও দেখা যেত। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া অথবা আপস করে দেশে থাকা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ—এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও পাড়ি জমায়। কারণ হচ্ছে, নিশ্চিত ও ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যতের সন্ধান। আর যারা রয়ে গেছে তারা মূলত মাথা নিচু করে দেশ পরিচালকদের সব অন্যায় প্রতিরোধ করা থেকে বিরত থেকেই রয়ে গেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ (জেন জেড) বাংলাদেশিরা তৃতীয় বিকল্পের দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে। তাদের পিতামাতার বিপরীতে তাদের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পশ্চিমে যাওয়ার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তার মানে সিস্টেমের মধ্যে থেকে পরিবর্তনের কাজ করতে হবে; তাদের স্বপ্ন দেশে থাকা এবং সংস্কার করা। তারা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিনিময়ে বা মূল্যে ছাড় দেওয়া মেনে নিতে রাজি নয়।
২০১৮ ও ২০২০-এর মধ্যে আমি বাংলাদেশে বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার সময় কয়েক ডজন তরুণের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাদের প্রায় সবাই দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য অবিশ্বাস্যভাবে গর্বিত; কিন্তু মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবনতির জন্য হতাশায় ভুগছিলেন। তারা তাদের দেশকে ভালোবাসত। ফলে তারা নীরব না থেকে দেশের জন্য ভালো করে তাদের ভালোবাসা দেখাতে চেয়েছিল।
ভাসাভাসাভাবে দেখলে মনে হতে পারে যে, ছাত্ররা অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনার সর্বশক্তিমান সরকারকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু না, এই বিপ্লব প্রস্তুত হয়েছে গত কয়েক বছরের গর্ভে। যেসব শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে এবং যারা তাদের জীবন দিয়েছে, তারা দেশের সরকারের স্বৈরাচারী এবং দুরাচার দেখে দেখে বড় হয়েছে।
গণতান্ত্রিক অবক্ষয় থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দ্বিগুণ করার প্রচেষ্টা দেখে দেখে অনেকেই তাদের তারুণ্যর প্রায় সবটুকু কাটিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারালে এর চাপায় দুই কিশোর মারা যায়। এরপর সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের জন্ম হয়। শিক্ষার্থীরা পাঁচ দিন ধরে রাস্তা দখল করে নেয়। তারা রাস্তায় গাড়ির লাইসেন্স চেকসহ ট্রাফিক পরিচালনা করে নিরাপদ সড়কের দাবি করেছিল। দেশটির সেসব সড়ক সত্যিকারই পুরোপুরি চলাচল অনুপযোগী। একই বছর একটি ছাত্র আন্দোলন সফলভাবে কোটা সংস্কার পদ্ধতির উত্থান ঘটায়। এরপর ২০১৯ সালে সরকারের সমালোচনা করে ফেসবুক পোস্টের জন্য এক সরকারপন্থি কর্মী কর্তৃক একজন ছাত্র খুন হয়। নিহতের এ ঘটনায়ও ছাত্ররা দলে দলে রাস্তায় নেমেছিল তখন।
এসব আন্দোলনের মধ্যে ছাত্ররা নিজেরাই দেখেছিল যে, সরকার সর্বদাই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার জন্য বিরোধী দলগুলোকে দায়ী করে। অবশ্য এসব কর্মের জন্য দায়ী মূলত সরকারের নিজস্ব ছাত্র সংগঠন। তারা এটাও দেখেছে যে, কীভাবে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা হাসিনা সরকারের কর্ম ও নীতির সমর্থন করেছে এবং এ সমর্থনের ক্ষেত্রে জাতির সামনে সরকারের মতোই হাজির করেছে অর্থনৈতিক সাফল্যের ঢাল।
বারবার তাদের বিপ্লবী চেতনাকে হতাশ হতে হয়, নিরাশার আবর্তে পড়ে যেতে হয়। তবুও তারা কিশোর থেকে যুবক হওয়ার পথে তাদের দেশের প্রতি আবেগ বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের জ্ঞান ও পরিপক্বতা প্রসারিত হওয়ার ভেতর দিয়েই। তারা বাংলাদেশকে শ্বাসরুদ্ধকর এক শাসক থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল এবং সত্যিকারের সম্ভাবনাময় একটি জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করতে চেয়েছিল। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যা সব নাগরিকের অধিকার সম্মান ও রক্ষা করবে।
পাঁচ সপ্তাহের রক্তপাত, যন্ত্রণা, ভয়, আতঙ্ক পেরিয়ে তাদের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। তরুণ বাংলাদেশিরা এখন দেশের দায়িত্বে রয়েছেন। সম্ভবত তাদের জীবনে প্রথমবারের মতো ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু হবে, এমন আশাবাদ বুকে ধারণ করছেন এই মুহূর্তে। নিশ্চিতভাবেই এখন বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। কিছু মানুষ এ সম্ভাবনা নিয়েও উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের সরকারগুলো যে মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আদর্শ—তা প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু ছাত্রনেতারা এরই মধ্যে অঙ্গীকার করেছেন যে, তারা নিশ্চিত করবেন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন হবে—যা দেশ আগে কখনো দেখেনি। তারা প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করবে যে, এই নতুন সরকার নিয়মের বাইরে যাবে না এবং জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবে না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, তারা তাদের কথায় অটল থাকবেন। কারণ এটিই তাদের দেশ, তাদের ভবিষ্যৎ এবং তাদের আজীবন স্বপ্ন, যা তারা অর্জন করতে চেয়েছিলেন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে যারা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, জোর করে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে তাদের কাছে এই বিপ্লবী যুবকদের সুস্পষ্ট বার্তা—স্বৈরশাসকের সময় শেষ। তারা এমন এক নতুন প্রজন্ম, যারা তাদের অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তারা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। সময় এখন তাদের। পরিবর্তন এখন অনিবার্য। আমাদের সবাইকে এ পরিবর্তনের হাওয়ায় ভাসতে হবে, পরিবর্তন গ্রহণ করতে হবে। নইলে এ ট্রেন থেকে ছিটকে পড়তে হবে।
লেখক: দক্ষিণ-এশীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার