ড. মো. মাহবুবুল আলম
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০২:৩৪ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ কি ইনডেমনিটি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ কি ইনডেমনিটি

প্রথমেই বলে নিই, আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ চাই কি না? উত্তর—হ্যাঁ। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি হয় না, হয় দুর্বৃত্তায়ন। সোজা বাংলায় গুন্ডামি বা ভাড়াটে কর্মী হয়ে বড় ভাই বা নেতার তোষামোদি। ভাই বা নেতার যত কাছে আপনি যেতে পারবেন, আপনি তত বড় ছাত্রনেতা হয়ে যাবেন। নেতা হওয়ার যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য আপনার থাক বা না থাক। সুতরাং এ ধরনের রাজনীতি থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনি প্রকৃতপক্ষেই রাজনীতি বন্ধ করতে পারবেন কি না? ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই উপমহাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, বলতে পারেন অগ্রণী ভূমিকা। আর তার হাত ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চলে আসে। সমরেশের কালবেলা যারা পড়েছেন, তারা জানেন, কীভাবে জলপাইগুড়ির এক সাধারণ ছেলে রাজনীতির এক কমরেড হয়ে ওঠেন। কিন্তু সে ধরনের ডেডিকেশন কি আর এখন আছে?

এখনকার যুগের ছাত্রনেতা মানেই বিশাল কিছু। আমি নিশ্চিত, গত পাঁচ-দশ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ছাত্রনেতা বের হয়ে গেছেন, তারা ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার সময় এক-দুটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং গাড়ির মালিক হয়ে গেছেন। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা, এটি নিশ্চিত। কেউ তাদের এই প্রশ্নও করেন না, ভাই, এত টাকা পেলেন কী করে? টিউশনি করে?

টেন্ডারবাজি, ড্রাগস, অস্ত্রবাজি, বড় ভাই বা নেতার ভাড়াটে কর্মী, চাকরি-ব্যবসায় তদবির—এটাই হলো আয়ের উৎস। মধ্যখান থেকে ব্যবহৃত হয় পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখা কিছু ছাত্রের স্বপ্ন ও অস্তিত্ব। সুতরাং এরকম নৈরাজ্যকর ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা অবশ্যই কর্তব্য।

কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি পুরোপুরি বন্ধ করা হয়তো সম্ভব হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এই দাবি তুলেছিলেন; কিন্তু তাদের প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টা এবং আরও কজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, এ ব্যাপারে তারা তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে আরও সময় নেওয়ার কথা বলছেন। তারা বলেছেন, এটি একটি পলিসিগত ব্যাপার, সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন। কেউ কেউ গঠনমূলক রাজনীতি বা ছাত্র সংসদের কথা বলেছেন। ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আগেও ছিল; কিন্তু নিয়মিত আয়োজন হয় না, কারণ ভাই বা নেতার পছন্দের প্রার্থীর সেখানে জেতার সুযোগ থাকে না। আর তা ছাড়া ছাত্র সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতাও দিনশেষে একই কাজ করে। বামদলগুলোর ছাত্র ইউনিটও ক্যাম্পাসে গঠনমূলক রাজনীতি বা অধিকারের কথা বলে। গঠনমূলক রাজনীতির আবরণে তাহলে কি বাম দলগুলোর ইউনিটগুলো ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকবে? রাজনীতি বন্ধ হলে তো সবার জন্যই হতে হবে। গঠনমূলক বা বঙ্গীয় বা ধর্মীয়—কোনো প্রেক্ষাপটেই সে ক্ষেত্রে রাজনীতি করার সুযোগ থাকা উচিত নয়।

এর মধ্যেই নোটিশ করে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার কর্তৃক নোটিশ ইস্যু হয়েছে। সম্ভবত ছাত্রদের চাপে পড়ে। রেজিস্ট্রার মহোদয়ের এককভাবে এই নোটিশ সার্কুলার করার এখতিয়ার নেই। সুতরাং ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবশ্যই সিনেট বা সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ড কর্তৃক নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই নোটিশ জারি করতে হবে। আর তার জন্য সময় লাগবে। কেননা, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এখন অভিভাবকশূন্য।

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য বুয়েট একটি উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু বুয়েটে সত্যি সত্যিই রাজনীতি বন্ধ হয়েছে কি না, তা বুয়েটের শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবেন। তা ছাড়া রাজনীতি করার অধিকার নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং রাজনৈতিক জনসমাবেশে গমন, ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আয়োজিত মিটিংয়ে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এখনকার কার্যক্রম রাজনীতির বাইরে নয়; বরং তারা সরাসরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হয়তো তাদের প্ল্যাটফর্মটির কোনো বিশেষ নাম তারা দেননি। কিন্তু যা শোনা যাচ্ছে, তারা শিগগিরই একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসবেন। সে ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মের নেতারা কি যার যার ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত রাখতে পারবেন?

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি মূলত হয় হলকেন্দ্রিক। হলের সিটগুলো থাকে রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। তাই প্রশাসনিকভাবে সিট বণ্টন, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বন্ধ করাসহ আরও কিছু উদ্যোগ ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়ক হতে পারে।

এখন আমার লেখার টাইটেলে আসি। বিগত ১৫-১৬ বছর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন প্রতিটি ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যেখানে অন্য সংগঠনগুলো কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া সংবাদ মোতাবেক ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনীতির যত নেগেটিভ ঘটনা এই ছাত্র সংগঠনের দায় বেশি। হল দখল থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, ছাত্র নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। একই কথা প্রযোজ্য সরকারদলীয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। বিগত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিপুল পরিমাণে সরকারদলীয় লোক নিয়োগ হয়েছে, অনেক আর্থিক অসংগতির অভিযোগ উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজনীতিকরণ একদিক দিয়ে বিগত দিনের নিপীড়নকারী সম্প্রদায়কে এক ধরনের ইনডেমনিটি দেওয়ার শামিল। সুতরাং ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার প্রেক্ষাপটে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি ‘ট্রুথ কমিশন’ গঠন করার সাপেক্ষে অন্যায় এবং অনিয়মের বিচারের সংস্কৃতি তৈরি করার উচিত। অন্যথায়, শোষকরা আবারও সুযোগে তাদের দানবীয় রূপ দেখাতে দ্বিধা করবে না, শোষিতের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।

লেখক: অধ্যাপক শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইজিপির অপসারণ ও বিচার চাইলেন পিন্টুর স্ত্রী

নিবন্ধনহীন নারী রাষ্ট্রের চোখে অদৃশ্য : নারীর অধিকার সুরক্ষায় শতভাগ নিবন্ধন জরুরি

চট্টগ্রামে নিহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বাড়িতে ব্যারিস্টার মীর হেলাল

কালবেলার অনুসন্ধানে ধরা হানিট্র্যাপ চক্র, আটক ২

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ নেতাকে শোকজ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ব্যর্থ অন্তর্বর্তী সরকার : টিআইবি

‘দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে’

আরএমপির ১২ থানায় ওসি পদে রদবদল

রাবির দ্বাদশ সমাবর্তন নিয়ে অসন্তোষ

খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য আইইবিতে দোয়া মাহফিল

১০

৩২ হাজার সহকারী শিক্ষককে দুঃসংবাদ দিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা

১১

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সোমবার

১২

যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা নিয়ে ‘সুখবর’ দিলেন সারাহ কুক

১৩

২০২৬ বিশ্বকাপে মেসিদের কত কিলোমিটার ভ্রমণ করতে হবে?

১৪

খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়া নিয়ে নতুন ভাবনা মেডিকেল বোর্ডের

১৫

নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্কের অধিকাংশ রাইডস ব্যবহারের অনুপযোগী

১৬

এক সপ্তাহে ১১ হাজারের বেশি প্রবাসীকে ফেরত পাঠাল সৌদি

১৭

যে কারণে স্কালোনির কাছে ক্ষমা চাইলেন ফিফা সভাপতি

১৮

আগামী নির্বাচন দেশ ও জনগণের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ : সেলিমুজ্জামান

১৯

যথাসময়ে আইনি পদক্ষেপ নেব : শিশির মনির

২০
X