কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তারাপদ আচার্য্য

অন্ধকার দূর করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম

অন্ধকার দূর করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম

‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’—স্বামী বিবেকানন্দের এ বাণীর মর্মার্থই হচ্ছে জীবকে সেবা করা, মানুষকে সেবা করা। আর জীবসেবা মানেই ঈশ্বর, আল্লাহ, শ্রীকৃষ্ণেরই সেবা। এ মুহূর্তে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সবাই। এখানে জাত-পাতের কোনো বিচার নেই। দেখা হচ্ছে না কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী। এই মানবিক বাণীকেই সামনে রেখে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত অর্থ যাচ্ছে বানভাসি মানুষের কাছে। তাদের মুখের হাসি দেখতে আজ সারা দেশ এক সারিতে দাঁড়িয়েছে। এটাই ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ এটাই প্রমাণ করছে যে ঐক্যই বড় বড় সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। এ ছাড়া সার্বিকভাবেই দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। একদিকে চলছে দেশ গোছানোর কার্যক্রম; অন্যদিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বন্যার ভয়াল রূপকে। দেশের মানুষ সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে পারবে শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে। কেটে যাবে অমানিশার কালো অন্ধকার। এই অন্ধকার দূর করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল আজকের দিনে।

দ্বাপরের যুগে পৃথিবীতে বহু ধর্মমত ও উপধর্মমত প্রচলিত ছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই বেড়ে যায় অরাজকতা। অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী হয়ে ওঠে ম্রিয়মাণ। ধর্ম ও ধার্মিকরা সংকটে দিনযাপন করতে থাকেন। অসহায় বসুমতি পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে দেবতারা যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তারা বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণীর দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে শঙ্খ, চক্র, গদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ নামে তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দেন এই ধরাধামে তার লীলার সহচর হয়ে জন্ম নিতে। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাদের নিজ নিজ পত্নীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলের বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নিতে থাকেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতারা মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে অরাজকতা থেকে মুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপালসহ অনেক অত্যাচারী রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির রোহিণী নক্ষত্রে বসুদেব-দেবকীর কোলে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। অষ্টমী তিথিতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে এই জন্মতিথির নাম জন্মাষ্টমী তিথি। শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন দুরাচারী কংসের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ ছিলেন। তাই ভগবানের জন্মক্ষণে কোনো আনন্দ হয়নি, কোনো মাঙ্গলিক কাজ হয়নি, উলুধ্বনি হয়নি, শঙ্খ বাজেনি! চারদিকে শুধু ভয় আর আশঙ্কা!

শ্রীকৃষ্ণ জন্মের পর কীভাবে তাকে রক্ষা করতে হবে সে কথা বসুদেবকে বলে দেন। তার কথামতো বসুদেব সূতিকাগার থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। গোকুলে নন্দ এবং যশোদার সন্তান রূপে যিনি জন্মগ্রহণ করেন তিনি ভগবানের অন্তরঙ্গ শক্তি যোগমায়া। যোগমায়ার প্রভাবে কংসের প্রাসাদে প্রহরীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কারাগারের দরজা আপনা-আপনি খুলে যায়। সে রাত ছিল ঘোর অন্ধকার। কিন্তু যখন বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে বাইরে আসেন তখন সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখতে পান। আর ঠিক সেই সময় গভীর বজ্রনিনাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বর্ষণ হতে শুরু হয়। বসুদেব যখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তখন ভগবান শেষসর্প রূপ ধারণ করে বসুদেবের মাথার ওপরে ফণা বিস্তার করেন। বসুদেব যমুনা তীরে এসে দেখেন যমুনার জল প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটে চলছে। কিন্তু এই ভয়ংকর রূপ সত্ত্বেও যমুনা বসুদেবকে যাওয়ার জন্য পথ করে দেন। এভাবে বসুদেব যমুনা পার হয়ে অন্য পাড়ে গোকুলে নন্দ মহারাজের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি সব গোপ-গোপীদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। সেই সুযোগে তিনি নিঃশব্দে যশোদার ঘরে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণকে সেখানে রেখে যশোদার সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে আসেন। নিঃশব্দে দেবকীর কোলে শিশুকন্যাটিকে রাখেন। তিনি নিজেকে নিজে শৃঙ্খলিত করেন যাতে কংস কিছুই বুঝতে না পারেন। কংস যখন যোগমায়াকে পাথরে নিক্ষেপ করে হত্যা করতে আদেশ দেন, তখনই যোগমায়া নিক্ষিপ্ত অবস্থায় আকাশে উঠে গিয়ে বলেন, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার জন্ম নিয়ে বলেছেন, তার জন্ম সাধারণ মানুষদের মতো নয় এবং তার মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায় কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটিই তার অলৌকিক লীলা। গীতাতে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।

পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর-নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু এটাই শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য নয়। বুদ্ধ, খ্রিষ্ট, শ্রীচৈতন্য অনেককেই অবতার বলা হয়, কিন্তু এসব অবতারের অসুর-বিনাশ নেই, এসব অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম-পবিত্রতা-জ্ঞান-ভক্তির অনুপ্রেরণা দেয়। পক্ষান্তরে, পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর-বিনাশ ব্যতীত আর বেশি কিছু প্রয়োজন দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন এবং বাহ্যজগতে মানব-সমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন।

বেদে বলা আছে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি করা খুবই কঠিন কাজ। এর পরও মানুষই সেই অসাধ্যকে সাধন করছে।

মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাকেই ভগবান বলে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মণীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাসিত হয়েছেন। ভক্তরা তাকে যে নামে ডাকেন, সে নামে তিনি সাড়া দেন। যেভাবে তাকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। সনাতনী সমাজে তার অবস্থান অনেকটা পরিবারের একজনের মতো। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাগারে তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণনামে।

চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি নহুশের পুত্র। যযাতির যদু, তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু, অণু ও পুরু এই পাঁচ পুত্র। এর মধ্যে যদু সবার বড়। শ্রীকৃষ্ণ এই যদুবংশে মহাত্মা বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। বসুদেবের পুত্র বলে তিনি বাসুদেব নামেও ভক্তদের কাছে পরিচিত। সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থ ‘কালো’। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কৃষ্ণানুসারীদের মতে ও সংখ্যাতত্ত্ববিদদের ধারণায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার ২২৮ অব্দে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্মতিথি নিয়ে মতান্তরও আছে। মতান্তর যাই থাক না কেন, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তার ভক্তদের কাছে ‘জন্মাষ্টমী’ হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ মেতে উঠুন ‘চায়ের আড্ডায়’

যুক্তরাজ্য থেকে বড় ধাক্কা খেল ইসরায়েল

আসিফ-মাহফুজকে পদত্যাগের আহ্বান ইশরাকের

হান্নান মাসউদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

মোবাইলে কথা বলার সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু

ইশরাককে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আদেশ আজ

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক ফোরামের নেতৃত্বে শাকিল-অনিক

‘টুকরো টুকরো হওয়ার শঙ্কায় সিরিয়া, গৃহযুদ্ধ আসন্ন’

সাদা পাথর লুটপাটে জড়িত ১৪ জনের কারাদণ্ড

গাজায় পুষ্টিহীনতা ও ওষুধের তীব্র সংকট, মৃত তিন শতাধিক

১০

আজকের দিন কেমন কাটতে পারে, জেনে নিন রাশিফলে

১১

শেরপুরে বন্যহাতির আক্রমণে দুজনের মৃত্যু

১২

দুপুরের মধ্যে ৫ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৩

টিভিতে আজকের খেলা

১৪

২১ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

২১ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৭

কাজে আসছে না কোটি টাকার ‘লাইটনিং এরেস্টার’

১৮

দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা

১৯

স্বাস্থ্য পরামর্শ / সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য পর্যাপ্ত ঘুম

২০
X