ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, করণীয়, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার প্রদানসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন
কালবেলা: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান আপনি কীভাবে পর্যালোচনা করবেন?
সেলিম রায়হান: জুলাই ও আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান আমরা দেখেছি, সেটা একটি মাত্র বিষয় কেন্দ্র করে ছিল না, বরং এটা দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অনেক বিষয়ের সম্মেলন। আমি অবশ্যই এটাকে বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখি। আমি আশা করি এ গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি নতুন যাত্রার সূচনা করবে। গত দেড় দশকে আমরা দেশের অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ ক্ষতি দেখেছি, যে লুটপাট-দুর্নীতি এবং গোষ্ঠীতন্ত্রের আধিপত্য দেখেছি, তা আমাদের দেশকে বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংক খাত, রাজস্ব খাত, রপ্তানি খাতসহ সব সেক্টরকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ সবকিছুই ঠিক করার একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতরে সমাজ ও দেশের কাছে উচ্চ প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। বর্তমান সরকার মানুষের সেই প্রত্যাশা কীভাবে পূর্ণ করবেন, সেটাই এখন দেখতে হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কোন বিষয়গুলো দায়ী মনে করেন?
সেলিম রায়হান: আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের শুধু ব্যর্থতা নয়, কিছু সাফল্যও ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম এক দশকে মোটামুটি উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ আমরা দেখেছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ভালো ছিল, আমদানি-রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও ভালো ছিল। মূল্যস্ফীতিও অনেকটা সহনশীল ছিল। কিন্তু এ সাফল্যের ভেতরেই ব্যর্থতার বীজ বোনা হয়েছিল। কারণ সাফল্যগুলো কোনো মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো ছিল না।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দুটি চালক ভালো কাজ করেছে বলে আমরা বলি। একটি হলো রপ্তানি এবং অন্যটি রেমিট্যান্স। কিন্তু যে সময়টা আমরা ভালো করেছিলাম তখন বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো সংকট ছিল না। ফলে তখন বিশ্ব বাণিজ্যেও বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। আমরা তারই সুফল পেয়েছিলাম। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার নীতিগত তেমন কোনো বড় পরিবর্তন ওই সময় করেনি, যাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।
আমরা গত কয়েক বছরে গোষ্ঠীতন্ত্রের যে আধিপত্য এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখেছি, সেটা হয়তো বিগত দশকে একটু কম ছিল। সবকিছু মিলে আমরা তখন কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিলাম। কিন্তু সে ভালো অবস্থানটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি কারণ আমরা শক্ত কোনো ভিত্তি তৈরি করতে পারিনি। কভিড এবং পরবর্তীকালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক সংকটে দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। আমাদের রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়ে পড়ে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীল অবস্থা ছিল সেটা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় পতন ঘটে। মূল্যস্ফীতির একটা বিশাল উল্লম্ফন ঘটে, যা আওয়ামী লীগ সরকার আর ম্যানেজ করতে পারেনি। এসব কিছু মিলিয়ে সাফল্যের পাল্লা থেকে ব্যর্থতার পাল্লাটা অনেক বেশি ভারী হয়ে গেছে।
এ ব্যর্থতার পাল্লা আমাদের অর্থনীতিকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, অর্থনৈতিক সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বড় বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক খাত, রাজস্ব খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার সব জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষতগুলো সারানো এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। সুতরাং এ অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দুরূহ একটি কাজের তালিকা নিয়ে সামনে এগোতে হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পেছনে কোন বিষয়গুলো দায়ী করেন?
সেলিম রায়হান: বাংলাদেশের অর্থনীতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে আমি অনেক বিষয়কেই কমবেশি দায়ী করব। ব্যাংক খাতে যেভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তার পেছনে অবশ্যই নীতিগত সমস্যা দায়ী। ঋণখেলাপি কমানোর জন্য কোনো ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ আমরা কখনোই দেখিনি। সুদের হারে নয়-ছয়ের অস্বাভাবিক নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ব্যাংক খাত তারা পরিবারতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। কর খাতেও কোনো ধরনের সংস্কার হয়নি। রপ্তানি বহুমুখীকরণে নীতিগত সমস্যা দেখেছি। পাশাপাশি কাঠামোগত বড় ধরনের দুর্বলতাও প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
আমরা বিগত সরকারের সাফল্যের যে এক দশকের কথা বলছি সেটাকে পাশাপাশি ব্যর্থতার দশকও বলতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের ব্যর্থতার একটি দশক ছিল। দেশের শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাতসহ মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে সব থেকে কম খরচের দেশ বাংলাদেশ। এখন যারা এই গণবিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে ছাত্ররা এই গণবিপ্লবকে সফল করতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাদের শৈশব কেটেছে গত এক দশকের মধ্যে। আর এ দশকেই রাষ্ট্র এই প্রজন্মের পেছনে সব থেকে কম খরচ করেছে। এই দশকটি ছিল বাংলাদেশের জন্য লোকসানের একটি দশক। পাশাপাশি রাজনৈতিক জায়গা থেকে এ সরকারের বড় ধরনের বৈধতার সংকট ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচন, ২০১৮ সালের নির্বাচন এমনকি ২০২৪-এর নির্বাচন কোনোটাকেই রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ রাজনৈতিক বৈধতার সংকটকে তারা অর্থনৈতিক সাফল্য দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করেছিল।
কালবেলা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথমে কোন দিকে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: অন্তর্বর্তী সরকার সব দিকে একই গতিতে এগোতে পারবে না। এজন্য তাকে সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন খাতকে সাজাতে হবে। সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অন্য কোনো দিকে এগোনো সম্ভব নয়। এরপর দ্বিতীয় প্রায়োরিটি থাকতে হবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য প্রতিদিন দেশের সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।
মুদ্রানীতি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থাপনা—এ সবকিছু একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। অতীতে আমরা এ সেক্টরগুলোর কোনো সমন্বয় দেখিনি। এ ছাড়া বাজারের চরম নৈরাজ্যে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখিনি আমরা। নতুন সরকারকে এ দিকগুলো খুব দ্রুত সমন্বয় করতে হবে। মূল্যস্ফীতি একদিনে কমে আসবে না। এজন্য আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা যৌক্তিক হতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের এ বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের কথাবার্তায় বাস্তবতার বাইরে গিয়ে অতি আশাবাদ ব্যক্ত না করে বসেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কালবেলা: খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে?
সেলিম রায়হান: এটি অসম্ভব দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এ কাজটি আমাদের করতেই হবে। ব্যাংক খাতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু গত দেড় দশকের নয়, এই ক্ষত দীর্ঘদিনের। তবে গত সরকারের আমলে এটা চরম আকার ধারণ করেছে। একপ্রকার লুটপাটের উৎসব চালানো হয়েছে এই খাতে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করা। একেবারে বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরতে হবে। এরপর ব্যাংক খাতের আইনগত সংস্কার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংক খাতে প্রফেশনালদের নিয়োগ করা জরুরি। আমলাদের দিয়ে ব্যাংক খাত চালানোর চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। আমরা দেখেছি ব্যাংক খাতে আমলারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এ সিস্টেমটা ভাঙতে হবে। যারা কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তারা এ বিষয়গুলো হাইলাইট করবেন। অন্তর্বর্তী সরকার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে আমি মনে করি।
কালবেলা: অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটা যে আবার বন্ধ হয়ে যাবে না, এটা নিশ্চিত করতে সরকার কী করতে পারে?
সেলিম রায়হান: দেশে এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সব দিকের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। সামাজিক সংস্কার করা গেলে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদাররা একটা চুক্তির মধ্যে আসবেন যে, সরকার পরিবর্তন হলেও তারা এই দিকগুলো পরিবর্তন করবেন না। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এ দেশের ছাত্র-জনতার অগ্রগামী অংশ, যারা এ গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে।
আমরা গোষ্ঠীতন্ত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখেছি। এর ফলে দেশের সত্যিকার ব্যবসায়ী শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারাও যদি এগিয়ে আসেন এবং পাশাপাশি রাজনীতিবিদরা যদি সৎ নিয়ত করেন, তাহলে একটি অর্থনীতির স্থায়ী সংস্কার সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা রাজনীতিবিদদের। সবাই মিলে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, পরিবর্তন হবে না।
কালবেলা: আমরা ট্রুথ কমিশন গঠন করে ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা দেখেছি। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। সে ক্ষেত্রে এ সরকার দুর্নীতিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও অভিযুক্তদের শাস্তি দেবে?
সেলিম রায়হান: ব্যবসায়ী হোন, আমলা হোন বা রাজনীতিবিদ—যারা অন্যায় করেছেন, দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী এবং শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যান। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই শুধু পারে অন্যদের দুর্নীতি-লুটপাট থেকে বিরত রাখতে। সরকারকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন নিরপরাধ কেউ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার না হয়। ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনগুলোতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে। গোষ্ঠীতন্ত্র ভেঙে সত্যিকারের বহুমুখী গণতান্ত্রিক এবং উৎপাদনশীল একটা বাংলাদেশের দিকে আমরা যেতে চাই। আর এখানে ব্যবসায়ী সমাজের ভূমিকা অনেক বেশি। তাই প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের প্রমোট করতে হবে যাতে তারা আমাদের ভালো কিছু দিতে পারেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক দায়িত্ব। আমরা জানি সরকারের পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সংস্কারের ভিত্তিটা এ সরকারকে গড়ে দিয়ে যেতে হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান যে সফলতার সূচনা করেছে, সেটার ধারাবাহিকতা যাতে ধরে রাখা যায় এবং সাফল্যটা যাতে কোনোভাবেই মলিন না হয়, সেদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট এবং টাকার অবমূল্যায়নের মতো সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?
সেলিম রায়হান: রাতারাতি এ অবস্থার উন্নতি হবে না। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় সরকারের এই মুহূর্তে উচিত আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে আসার চেষ্টা করা। রিজার্ভ সংকটের তাৎক্ষণিক চাপ থেকে এ উদ্যোগ আমাদের রেহাই দেবে। কিন্তু এটা চিরস্থায়ী কোনো সমাধান নয়। আমাদের খুব দ্রুত রিজার্ভ সংকট থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বিশেষ করে রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
পাশাপাশি যদি একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যায় তাহলে আমাদের জন্য অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। ড. ইউনূসসহ এ সরকারের উপদেষ্টাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তারা যদি তাদের ইমেজকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান, তাহলে অনেকেই তাতে সাড়া দেবেন বলে মনে করি। রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে বিদেশি বিনিয়োগসহ রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বহুমুখী উপায় বের করতে হবে।
কালবেলা: জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানিতে আমাদের অনেক টাকা দেনা পড়ে গেছে। এসব ঋণ সরকার কীভাবে শোধ করবে?
সেলিম রায়হান: বিদ্যুৎ খাতে কী পরিমাণ অনিয়ম-লুটপাট হয়েছে, এটা আমরা জানি। আমাদের আসলে প্রত্যেকটা খাতভিত্তিক অ্যাসেসমেন্ট দরকার। এ অ্যাসেসমেন্টগুলো দেখে পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে উত্তরণের একটা পথ বের হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের ঋণগুলো যদি আমরা শোধ করতে না পারি, তাহলে আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারব না। ব্যাংক খাতের মতো জ্বালানি খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন।
কালবেলা: বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
সেলিম রায়হান: আমরা জানি কাগজে-কলমে অনেক কিছুই রয়েছে কিন্তু বাস্তবে তা অনুসরণ করা হয় না। আর এর পেছনের কারণ হলো রাজনৈতিক অর্থনীতি। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন সব লোক বসায় যারা কোনো না কোনোভাবে এ সরকারের স্বার্থকে দেখবে। এটি সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার যদি থাকে গোষ্ঠীতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা, তাহলে আমরা আবার ওইরকম দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাব।
সামনের দিনে যে সরকারই ক্ষমতায় আসবে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারটা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট হতে হবে। যদি তারা সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এর জন্য বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন এবং শক্তিশালী করা জরুরি। সবকিছু মিলে একটা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে যাতে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই দলীয়করণ না হয়ে পড়ে।
কালবেলা: কর্মসংস্থান সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে?
সেলিম রায়হান: গত সরকারের শাসনামলের প্রথম এক দশক যখন প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল বলে বলছি ওই সময়টা একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিল ব্যর্থতার দশক। আমি সে সময় লিখেছিলাম জবলেস ইকোনমিক গ্রোথ। কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেকারত্ব সমস্যা এবারের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম একটি কারণ। দেশে শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ বের করতে না পারলে এ সমস্যাটা জিইয়ে থাকবে। আমাদের সব থেকে বেশি যেটা দরকার, তা হলো ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। গত দুইয়ের দশকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে বড় ধরনের একটি স্থবিরতা দেখেছি আমরা। একই সঙ্গে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক খাতে ঋণ পেতে হাজারো সমস্যা ফেস করতে দেখেছি আমরা। তারা নানাভাবে নানা দিক থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
আমাদের প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশি ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে। আমরা যদি এ পরিবেশটা তৈরি করতে পারি, তাহলে আমাদের এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারব।