অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩৩ এএম
আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকার

বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত নয়

বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত নয়

আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যবিরোধী তত্ত্বচর্চা ও লড়াইয়ে সক্রিয় তিনি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যে কোনো প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন সবসময়। ছিলেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। বাংলাদেশে মার্ক্সীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি-সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি সবচেয়ে পরিচিত লেখক। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার, দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকারসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন।

কালবেলা: জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দেয়?

আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার এ গণঅভ্যুত্থানের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি দীর্ঘ সময় ধরে যেভাবে জনগণকে নির্যাতন করেছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ করেছে—এতেই মানুষ তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে দেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে গেছে; জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি করেছে; মেগা প্রকল্পের নামে ভয়ংকর সব দুর্নীতি করেছে এবং বিভিন্নভাবে দখলবাজি ও নানা উপায়ে মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত না করে লুটপাট করে গেছে।

বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সেভাবে আস্থা রাখতে পারেনি। তাই রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বৃহদাকার তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আন্দোলন কোনো না কোনোভাবে ছিল। বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে, একাধিক বড় বড় ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। হাসিনা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লেখালেখি হয়েছে। হামলা, হুমকি, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ বিভিন্ন আইনের ভয় মাথায় নিয়েই প্রতিবাদ হয়েছে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করেছে। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও প্রতিবাদ উঠেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনও সাধারণ একটি আন্দোলন ছিল। এটা ছিল শিক্ষার্থীদের অধিকারের আন্দোলন। সরকারের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া মোটেই কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু সরকার তার স্বৈরতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব এবং জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার অভ্যাস থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মানতে অস্বীকার করে। সরকার শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। সরকার একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নানা টালবাহানা এবং বলপ্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু বলপ্রয়োগের ফলে ছাত্রদের এ আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে এবং ব্যাপক আকার ধারণ করে।

পহেলা জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করেছে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে তাদের বাদ দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। এ দুই জায়গাতেই সরকারি দলের অনেক লোকজন অংশগ্রহণ করে। যে শিক্ষকরা সারাক্ষণ সরকারের তোষামোদি করতে ব্যস্ত থাকত, তারাও আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মবিরতিতে যান। একই সঙ্গে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের অনেক কর্মীও অংশগ্রহণ করে। কারণ ছাত্রলীগের কিছু সুবিধাভোগী থাকলেও বাকিদের চাকরি প্রয়োজন ছিল। তাদের জীবিকা দরকার। আওয়ামী সরকারের লুণ্ঠনমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেনি। তাই জীবিকার কথা চিন্তা করে অনেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশে মূলত চারটি দল স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশে বড় কোনো আন্দোলন তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যানারে হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। কারণ দেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর গায়ে অনেক কলঙ্ক রয়েছে। তাদের অতীত ইতিহাস এবং রেকর্ড মানুষ ভোলেনি। আমরা দেখেছি এ আন্দোলনটা কীভাবে রাজনীতির ব্যানারের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের ভেতর থেকে উঠে এসেছে। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে বৃহৎ আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক দল আবশ্যকীয় নয়। জনগণ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেও একটি ব্যাপক আন্দোলন তৈরি হতে পারে।

এ আন্দোলন থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, কোনো অন্যায় চিরদিন চলতে পারে না। একটা দীর্ঘ অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যখন মানুষ জেগে ওঠে এবং বিদ্রোহ করে তখন সেটা অপ্রতিরোধ্য হয়।

কালবেলা: আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ কখন ঘটতে থাকে এবং কেন ঘটে?

আনু মুহাম্মদ: মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের সামনে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া অন্য পথ ছিল না। তা ছাড়া এটা ছিল একটা ন্যায্য আন্দোলন। তাই দলমত নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এ আন্দোলনে। প্রথমে তারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেনি, শুধু তাদের দাবি জানায়। কিন্তু সরকার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদের ওপর আক্রমণ করা শুরু করে। সেটা জনগণ গ্রহণ করতে পারেনি।

প্রথমত, জনগণের মধ্যে আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল, তারপর শিক্ষার্থীদের ন্যায্য এ আন্দোলনে নৃশংসভাবে হামলা—সবমিলে জনগণ মাঠে নেমে আসে। সেখানে শ্রমিক, কৃষকের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। সরকার যত নৃশংসতা বাড়াতে থাকে আন্দোলনে জনগণের সমর্থন এবং সম্পৃক্ততা তত বাড়তে থাকে। মানুষ সরকারি বাহিনী ও তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের আক্রমণকে সম্পূর্ণ তুচ্ছজ্ঞান করে দৃঢ়তার সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে।

শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের সূত্রপাত করলেও একসময় এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের। শ্রমিক, শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী নির্বিশেষে এ আন্দোলন হয়ে ওঠে সবার। আন্দোলনে একদিকে গণমানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে; অন্যদিকে সরকারকে দেখা যায় আক্রমণাত্মক। ৪ আগস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তেও সরকারের মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা যায়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনও বলেছিলেন, এ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করছে তারা সবাই সন্ত্রাসী, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শেখ হাসিনা সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংসতা আরও বাড়াবে।

২ আগস্ট দ্রোহযাত্রার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের দাবিটা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। এরপর সরকারের পতন ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। কারণ সরকারের বলপ্রয়োগের সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব ছিল না। গুলি করে মানুষ মেরে তাদের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। একদিকে পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও গুলি চালানো অব্যাহত রাখে; অন্যদিকে ছাত্র-জনতার মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

কালবেলা: গণআন্দোলন সফল হওয়ার পর এখন রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠছে। এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী বলে মনে করেন?

আনু মুহাম্মদ: এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণমানুষের একটি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তারা একটি পরিবর্তন চান। এজন্য তারা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছেন। মানুষ বলছে, আমরা আর আগের মতো অবস্থা চাই না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বা বিএনপির যে শাসনকাল মানুষ এখনো মনে রেখেছে, সেই ধরনের শাসন মানুষ আর দেখতে চায় না। তরুণ শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালের গ্রাফিতিগুলো বলছে, আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই; যেখানে কোনো নিপীড়ন থাকবে না, কোনো বৈষম্য থাকবে না।

বৈষম্যহীন কথাটির ক্ষেত্র অনেক বড়। এ বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে একটা দেশকে অগ্রসর হতে গেলে তার রাজনীতি খুবই স্পষ্ট হতে হবে। রাজনীতির লক্ষ্য এবং কর্মসূচি স্পষ্ট হতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত সেটা দেখিনি। মানুষের মধ্যে সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা কোন দিকে যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক দলগুলো বৈষম্যহীনতার কথা বলছে কিন্তু বৈষম্যেরই রাজনীতি করছে। যদি এমনটাও ঘটে যে, ভিন্নমতের ওপর হামলা হচ্ছে তাহলে সেটাও এই সম্পূর্ণ বৈষম্যহীনতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীত। যত দ্রুত রাজনীতির লক্ষ্য এবং কর্মসূচি স্পষ্ট হবে, ততই ভালো।

আমরা জানি স্বৈরাচারী সরকারের নানা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ছিল। একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি ছিল যারা খুব দ্রুত অর্থসম্পদের মালিক হয়েছে। এ ছাড়া নানারকমের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ছিল যাদের সরকার নানাভাবে সুবিধা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির নানারকম স্বার্থ এখানে যুক্ত। ফলে এসব সুবিধাভোগী এবং আন্তর্জাতিক শক্তির নানারকমের প্রচেষ্টা ছিল এই দেশকে নিজেদের স্বার্থের দিকে নিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশ যদি জনগণের হাতে আসে তাহলে তারা কেউ খুশি হয় না। তারা সবাই চাইবে তাদের পালিত বা তাদের সুবিধা দেবে এমন কোনো গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা থাকুক। এ চেষ্টা এখনো দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একটি বড় দায়িত্ব নিয়েছে এবং তাদের সামনে বিরাট পরীক্ষা। এই গণঅভ্যুত্থান থেকে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, গুরুদায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।

কালবেলা: আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং সাহসী ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন?

আনু মুহাম্মদ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের প্রায় সবার সাধারণ ধারণা যে, এখানে শুধু উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই পড়ালেখা করে। কিন্তু এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। আমি এমন অনেক পরিবারকে চিনি যারা ঋণ করে এবং পরিবারের সম্পত্তি বিক্রি করে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াচ্ছেন। শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে মানুষ সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে পরিবারের অন্য সদস্যরা রক্ত বিক্রি করে হলেও তার চিকিৎসা করার চেষ্টা করে। তেমনি সন্তানের লেখাপড়ায় একজন অতিদরিদ্র ব্যক্তিও তার সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে গত এক দশকে এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। একজন দরিদ্র পিতাও মনে করছেন শিক্ষার ওপর ভর করে তার সন্তান যেন দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র থেকে বের হতে পারে।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট আসন নেই। এ কারণে কষ্ট করে হলেও অভিভাবকরা সন্তানদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন। উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানরা দেশে লেখাপড়া করে না। তারা সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়া করতে পাঠায় এবং তাদের এ দেশের কোনো চাকরিও দরকার নেই। কিন্তু এই দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জীবিকার প্রয়োজন।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনের শুরু থেকেই সমর্থন জুগিয়েছে। তারা যখন দেখছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, তখন তারা ঘরে বসে থাকতে পারেনি। তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং রাস্তায় নেমেছে। আমাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেছে, যখন পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাল, আমার সামনে ছয়জন শিক্ষার্থী মারা গেল। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, কিন্তু আমি সেখান থেকে সরতে পারিনি। কারণ আমার মনে হয়েছে, অন্যদের রেখে আমি এখান থেকে সরে যেতে পারব না।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল যে, মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মমর্যাদার বোধ তৈরি হয়েছে। এ সময়টায় মানুষ তার বিবেক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল এবং তাদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ সামনে ছিল না। প্রত্যেকে চিন্তা করছিল যাতে সবাই নিরাপদ থাকে এবং সবাইকে রক্ষা করা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যখন পুলিশের সঙ্গে পেরে উঠছে না, মার খাচ্ছে; তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারাও যখন রাস্তায় মার খাচ্ছে তখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসে। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী তার মাকে চিঠি লিখে যাচ্ছে, আমি আর ঘরে থাকতে পারছি না, আমি মিছিলে যাচ্ছি।

আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন ও নৃশংসতা সমাজের সব মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে দিয়েছে। এটাই ছিল এ আন্দোলনের সব থেকে বড় অভিজ্ঞতা।

কালবেলা: এ প্রজন্ম নিয়ে একটি ধারণা ছিল যে, তারা সমাজের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে সচেতন নয়। তারা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া ও নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আনু মুহাম্মদ: তরুণদের সম্পর্কে বড়রা সবসময়ই একটু ভুল ধারণা করেন। বড়রা সবসময় বলেন, তরুণরা অবক্ষয়ের শিকার। এমন প্রবণতা সবসময়ই ছিল, সব জেনারেশনেই ছিল। আমরা জানি শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে সংবেদনশীলতা অনেক বেশি থাকে। তাদের মধ্যে মায়া-মমতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা বেশি থাকে। তরুণরা অনেক বেশি মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। সত্যি তারা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে থাকে বিষয়টি তেমন নয়। মোবাইলে আরও অনেক কিছুই দেখা যায়, করা যায়। দেশ-বিদেশের সব খবরাখবর মোবাইলেই রাখা যায়। ফলে আমাদের তরুণরা টেকনিক্যালি সক্ষম ও দক্ষ হচ্ছে। এ প্রজন্ম কমিউনিকেশনের দিক থেকে এবং তথ্য সংগ্রহের দিক থেকে অনেক বেশি দক্ষ। বিষয়টা এমন যে, যখন সে ব্যক্তিগত জগতে থাকে তখন সে একরকম আর যখন সমাজের মধ্যে কোনো নড়াচড়া হয়, তখন সে দ্রুত তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। এখানে টেকনোলজির বড় ভূমিকা রয়েছে।

কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠছে। অনেকে সংবিধান সংস্কারের কথাও বলছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশে জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যসহ নানারকম বৈষম্য রয়েছে। এই সবকিছু থেকে বের হতে হলে একটা কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। আমরা একটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি যেটাকে পুঁজিবাদ বলে। আর এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বৈষম্য একটি অনিবার্য পরিণতি। এখানে কিছু লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং তারাই রাষ্ট্র চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশ, বলপ্রয়োগকারী সংস্থা ও আইনগত কাঠামো। ফলে আমরা যদি বৈষম্যহীন ও সর্বজনীন বাংলাদেশ গড়তে করতে চাই, তাহলে এসব সমস্যা নির্দিষ্ট করতে হবে। এই দায়দায়িত্ব এতটাই বেশি, যা অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়।

শুধু সংবিধান পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। কারণ সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা চলে না। বরং ক্ষমতা অনুযায়ী সংবিধান তৈরি হয়। সংবিধান অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক বা সাম্প্রদায়িক। এর মূল কারণ সিস্টেম বা ব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক। আমরা যে রাষ্ট্রের মেরামতের কথা শুনছি সেখানে সংবিধান একটি অংশ মাত্র। আমাদের প্রয়োজন সামগ্রিক কাঠামোর সংস্কার। যেমন, দেশের শিক্ষা কি বাণিজ্যিক থাকবে নাকি সর্বজনীন হবে? দেশের চিকিৎসা বাণিজ্যিকীকরণ হবে নাকি সবার অধিকারে আসবে? পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কি সবার হবে নাকি কিছু মানুষ প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট দিয়ে সারা ঢাকা শহরের রাস্তা দখল করে রাখবে আর অন্যরা বাসে ঝুলবে? মোটকথা পাবলিক ইন্টারেস্ট অর্থাৎ সর্বজনের স্বার্থকে সামনে নিয়ে যে রাজনীতি তার শক্তি বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ হবে।

সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। আর এর জন্য সরকারের একটি সংবিধান সংশোধন কমিশন গঠন করা উচিত। সেখানে বিশেষজ্ঞরা দেখবেন যে কোন কোন জায়গায় বৈষম্য এবং নিপীড়নের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। সেগুলো থেকে মুক্ত একটি সংবিধান তৈরির জন্য তারা সুপারিশ করবেন। বৈষম্যহীন সংবিধান প্রস্তাব করে সেটা জনমতের জন্যও ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। দেশের সম্পদের মালিকানা ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অথচ এগুলোর মালিক বাংলাদেশের মানুষ। এগুলো রাষ্ট্রের নীতি-কৌশলগত বিষয়। এভাবে বিভিন্ন সেক্টরে যে প্রশ্নগুলো রয়েছে তার উত্তর খুঁজতে হবে। সেই উত্তরগুলোকে জনগণের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক সত্যি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।

কালবেলা: রাজনৈতিক দলগুলো কি বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করেন?

আনু মুহাম্মদ: বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো একদমই প্রস্তুত নয়। প্রতিটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের একটি শক্তি প্রকাশিত হয়। জনগণের সংগঠিত শক্তি যখন দুর্বল হয় তখন রাজনৈতিক দল, সামরিক বাহিনী কিংবা আমলাতন্ত্র আবার তাদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এজন্য জনগণের মধ্য থেকে যে শক্তি বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়, সেটা ধরে রাখাই বড় কাজ। যারা জনগণের সেই শক্তির পক্ষে এবং যারা মনে করেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তৈরি প্রয়োজন, তারা আপাতদৃষ্টিতে যতই ছোট হোক তারা যদি এ শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং একত্র হয় তাহলে ক্রমাগত সমাজের মধ্যে একটি মতাদর্শিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এটি একটি সংগ্রামের বিষয়। বর্তমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগীরা সহজে ছাড় দেবে না। সুতরাং তাদের মোকাবিলা করা এবং তাদের সঙ্গে লড়াই করতে জনগণের শক্তিকে দাঁড় করানো প্রয়োজন। জনগণের সেই শক্তিকে দাঁড় করানোর জন্য অব্যাহত চেষ্টা এবং লড়াই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের যে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে সেটা জনগণের শক্তিকে একটি কাঠামো দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণের এ শক্তি আমাদের জন্য বড় অবলম্বন। একই রকম আরেকটা অবলম্বন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমরা সবসময়, অন্যায়, নিপীড়ন ও স্বৈরাচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা খুঁজি। ফলে সেই শক্তির সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের এই শক্তি যুক্ত করতে হবে। আমি আশা করি অবশ্যই এমনটা ঘটবে। বাংলাদেশের মানুষ বৈষম্যবিহীন একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে একাট্টা হয়ে দাঁড়াবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘খুনিদের বিচার না করলে বর্তমান সরকারকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে’

দাদাগিরি করতে গিয়ে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত : মুরাদ

বগুড়ায় ডা. জুবাইদার লেখা বই বিতরণ ও ফ্রি হৃদরোগ চিকিৎসা ক্যাম্প

হৃদরোগীদের জন্য ডা. জোবায়দা রহমানের পরামর্শমূলক বই বিতরণ উদ্বোধন

মাহমুদউল্লাহ পারেন কিন্তু বাকিরা…

ফ্যাসিবাদের হোতা আ.লীগের বিচার হবেই হবে : প্রিন্স

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ২৪১

কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক

২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা যেতে পারে : জামায়াত সেক্রেটারি

দুঃসংবাদ দিল তিতাস গ্যাস

১০

যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ ও ‘বিজয় দিবস’ পালনের আহ্বান ডা. শফিকুর রহমানের

১১

কুড়িগ্রামের উলিপুর সীমান্তে ২ পাচারকারী আটক

১২

ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব; গ্রেপ্তার সাকিবদের মালিক

১৩

মার্কিন উপকূলে ইরানের যুদ্ধজাহাজ, আকাশে উড়ছে ড্রোন!

১৪

নারী ফুটবল র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭ ধাপ উন্নতি বাংলাদেশের

১৫

বোমা মেরে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

১৬

জিএমপির ডিসি কার্যালয়ের সামনে জুবায়েরপন্থিদের বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান

১৭

আ.লীগের চরিত্র বদলায়নি : জামায়াত আমির

১৮

২৫ মার্চ কালরাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন কবি হেলাল হাফিজ

১৯

বাকৃবিতে জাতীয় ভাষা উৎসব শুরু

২০
X