মোনায়েম খান ও ড. মো. সরোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০৪ এএম
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইনে ‘জেন্ডার’ শব্দের অস্পষ্টতা দূর হোক

আইনে ‘জেন্ডার’ শব্দের অস্পষ্টতা দূর হোক

অন্তর্বর্তী সরকার বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে করার উদ্যোগ নিয়েছে। মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করে দেশে-বিদেশে কুখ্যাতি অর্জন করেছে এই ট্রাইব্যুনাল। সে কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যার বিচার এ ট্রাইব্যুনালেই করা উচিত নাকি অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত, তা নিয়ে আজকে আমাদের আলোচনা নয়। আমরা একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাসরের খবর অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালের আইনে আটটি বিষয়ে সংশোধনী আনার খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “সংশোধনের খসড়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করা… প্রস্তাব করা হয়েছে।” খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরা সিনিয়র আইন সচিবের বরাতে আরও বলা হয়েছে, “এই সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোর করে যৌনকর্ম, জোর করে গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগের আইনে ছিল না।”

স্পষ্টতই লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা (gender-based violence) ও অন্যান্য যৌন অপরাধকে আইনের বিচারিক আওতাভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিকট অতীতে আমাদের দেশে স্বৈরাচারী সরকার আমলে এ ধরনের অপরাধ হওয়ার অভিযোগ শোনা যায়নি। তারপরও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই হয়তো এসব অপরাধকে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এখতিয়ারভুক্ত করা হচ্ছে। যৌন অপরাধের বিচার আমাদের প্রচলিত আইনেও ‍সুযোগ রয়েছে। এখানে widespread and systematic (ব্যাপক ও পদ্ধতিগত) অপরাধের বিচার উদ্দেশ্য। তবে আমারা সুনির্দিষ্টভাবে ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, সে বিষয়ে আগ্রহী।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি মূলত নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মূল সনদ ১৯৯৮ সালের ‘রোম সংবিধি’-কে অনুসরণ করেই সংশোধন করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। উদ্দেশ্য হলো, বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও মানবাধিকার নীতি মেনে চলা।

রোম সংবিধিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিভিন্ন যৌন অপরাধের ‍বিচারের সুযোগ রয়েছে। Article 7 (1) (g) অনুযায়ী, Rape, sexual slavery, enforced prostitution, forced pregnancy, enforced sterilization, or any other form of sexual violence of comparable gravity; এগুলো আইসিসিতে বিচারযোগ্য অপরাধ। দৃশ্যত সেসব যৌন অপরাধ বা সহিংসতাই এখন ১৯৭৩ এর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। লক্ষণীয় হচ্ছে, খসড়া আইনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা (gender-based violence) নামে নতুন অপরাধের সংযোজন প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু রোম সংবিধিতে gender-based violence নামে কোনো অপরাধ নেই। তবে gender persecution বলে একটি অপরাধের উল্লেখ আছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি কারণে persecution (মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ)-এর মতোই জেন্ডার পারসিকিউশন একটি অপরাধ। অধিকন্তু, (Article 7 (3) )-এ জেন্ডারের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে এভাবে—“For the purpose of this Statute, it is understood that the term ‘gender’ refers to the two sexes, male and female, within the context of society. The term ‘gender’ does not indicate any meaning different from the above.” তার মানে সেখানে জেন্ডার বলতে সুনির্দিষ্টভাবে জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) নারী ও পুরুষ, অর্থাৎ শুধু দুটি লিঙ্গকে বোঝানো হয়েছে, এর বাইরে কিছু নয়।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা’ বা (gender-based violence) বলতে জেন্ডারের সে সংজ্ঞাই (অর্থাৎ জৈবিক নারী-পুরুষ দুটি মাত্র লিঙ্গ) এ সংশোধনীতে বোঝানো হচ্ছে। সংশোধনী পাস করার আগে অবশ্যই সেটি স্পষ্ট করতে হবে এবং আইনে স্পষ্টভাষায় সেটির উল্লেখ থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা’র আড়ালে জেন্ডার আইডিওলজি/ ট্রান্সজেন্ডারবাদ তথা এলজিবিটিকে বৈধতার সুযোগ যাতে ভবিষ্যতে তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যেসব যৌন অপরাধ বা সহিংসতা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো যেন আমাদের দেশের বিদ্যমান আইন তথা পেনাল কোড, ১৮৬০ (বিশেষভাবে ধারা ৩৭৫, ৩৭৭) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০০ এর যৌন অপরাধের সংজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেটাও নজরে রাখতে হবে।

বর্তমান সময়ে লিঙ্গ ও যৌনতার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালের আগেও জেন্ডার বলতে সাধারণত নারী ও পুরুষকে বোঝানো হতো, কিন্তু বর্তমানে লিঙ্গবৈচিত্র্যের মোড়কে জেন্ডার ১০০টির অধিক এবং দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছেই। প্রসঙ্গত, ব্র্যাকের সমতন্ত্র প্রকল্পে ব্যানারের জেন্ডার বলতে ৭৩টি প্রচার করায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল কেননা এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সমকামী অধিকারের বিষয়। তাই এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার অভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক বিতর্ক-বিভাজন উসকে যেতে পারে। এর তীব্রতা কেমন হতে পারে তা এ বছরের শুরুতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে বইয়ের পাতা ছেঁড়ায় ঘটনায় কিছুটা আঁচ করা গেছে। জেন্ডার শব্দকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বের একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তাই ভবিষ্যতের যে কোনো বিতর্ক এড়াতে জেন্ডার শব্দের পরিবর্তে সেক্স শব্দ ব্যবহার করা বেশি মঙ্গলজনক হবে।

মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতা-শ্রমিকের রক্তের নদী বেয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে জেন্ডার কেন্দ্র অত্যন্ত সংবেদনশীল অস্থিরতা কারও কাম্য হতে পারে না। পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসররা বিভেদ সৃষ্টি করে যে কোনো সুযোগ নেওয়ার পাঁয়তারা থেকে মোটেও পিছপা হবে না। অহেতুক বিতর্ক তৈরি করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাক, তা আমরা কেউ চাই না। আমাদের বিতর্ক-বিভেদের ঊর্ধ্বে থেকে বঞ্চিত-মজলুম জনতার ন্যায় ও সাম্যের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখকদ্বয়: মোনায়েম খান, শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন, স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তেঁতুল খেলে কি শরীরের রক্ত পানি হয়ে যায়? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ঢাকা

নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদনের শেষ দিন আজ

আজ ঢাকার আকাশ কেমন থাকবে?

আমেরিকানদের কথা বাদ দিয়ে ‘ট্রাম্প শুনছেন নেতানিয়াহুর কথা’

‘পানির দামে’ বিক্রি হচ্ছে দুধ 

হাজারীবাগে আগুন নিয়ন্ত্রণে

ইরানে মার্কিন হামলা / ট্রাম্প কি এবার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন

সকালের নাশতা বাদ দিলে যা হতে পারে

ইরানে মার্কিন হামলার পর আতঙ্কে নিউইয়র্ক, কড়া নিরাপত্তা জারি

১০

প্রথমবার একসঙ্গে অপি, সাগর ও তাহসান 

১১

আমি নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানাচ্ছি : ট্রাম্প

১২

৯ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১৩

কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে শৈল্পিক বাবুই পাখি

১৪

ইরানে হামলার পরপরই ট্রাম্প-নেতানিয়াহু ফোনালাপ

১৫

আগের ভিডিও শেয়ার করে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করলেন খামেনি

১৬

‘জমেছে হতাশা, বাড়ছে ঋণের বোঝা’

১৭

টিভিতে আজকের খেলা 

১৮

বিএনপির দুপক্ষের দ্বন্দ্ব, বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা

১৯

‘টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ ধ্বংস করে পর্যটন চলতে পারে না’

২০
X