কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৫ এএম
আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মো. আখতারুজ্জামান

অন্তর্বর্তী সরকার ও অতঃপর?

অন্তর্বর্তী সরকার ও অতঃপর?

বলা বাহুল্য বর্তমান বাংলাদেশ তথা আমরা জনগণ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এ মুহূর্তে বা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা কেউই বলতে পারব না কাল বা পরবর্তীকাল দেশে কী হবে বা হতে যাচ্ছে! কারণ ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত একটি স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র হরণ হবে, জনগণ নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবে না, আইনের শাসনের পরিবর্তে চলবে দলীয় শাসন, রাজনীতির পরিবর্তে হবে অপরাজনীতি, রাজনীতি হবে অর্থসম্পদ বানানোর মেশিন, বিরোধী মতাবলম্বীদের গুম ও খুন এর কোনো কিছুই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল না; কিন্তু সেটাই হয়েছে! শুধু হয়েছে বললে অসম্পূর্ণ হবে। বলতে হবে চরম আকারে হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? সমস্যাটা যেহেতু এক দিনে তৈরি হয়নি, সেহেতু রাতারাতি সমাধানও সম্ভব নয়। আর সমস্যাগুলো এত তীব্র ও জটিল যে, কোনো একক ব্যক্তি, দল বা দলীয় সরকারের পক্ষে সমাধান করা একেবারেই অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একটি বৈপ্লবিক সংস্কার, যা শুধু সব দলমত ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটা বৈপ্লবিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সফল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হলেও, এখানে সব দলমত ও শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই। এ সরকার আপৎকালীন তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে গঠিত একটি সরকার। সুতরাং তাদের দ্বারা সব মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে না এবং তাদের দ্বারা সবক্ষেত্রে প্রত্যাশিত বৈপ্লবিক সংস্কারও সম্ভব নয়। কারণ বৈপ্লবিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজন বিপ্লবী সরকার।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দল ও অংশীজনের সমন্বয়ে বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন না করে! সেদিন যদি জাতীয় সরকার গঠন করে ঔপনিবেশিক ধাঁচের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক সংস্কার করা হতো, তাহলে বাংলাদেশকে বাঁকে বাঁকে এত করুণ পরিণতি দেখতে হতো না। সেদিন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় সরকার তো দূরের কথা, ন্যূনতম সুস্থ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিকেও সংকুচিত করা হয়েছিল। যেখানে গণতন্ত্রের একটি অন্যতম শর্ত হলো পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। এ প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসনের একটি উক্তি উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত তোমার বিরোধিতা করে যাব, তবে তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমার নিজের জীবন দেব।’ আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, ‘Democracy is The government of the people by the people for the people.’ কিন্তু আমাদের দেশের চিত্রটা দেখা গেল সম্পূর্ণ উল্টো। গণতন্ত্রকে বিকশিত করার পরিবর্তে শুরু হলো বিরোধী দলকে দমনপীড়নের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার সংস্কৃতি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রলীগের মেধাবী এবং প্রগতিশীল অংশ যাদের শতভাগই ছিল বোনাফাইড মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দাবি ছিল বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের। কিন্তু দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তারা সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে একটি গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যা তখনকার জন্য ছিল অপরিহার্য। সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা যদি বজায় থাকত, সরকার যদি সংবিধান এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকত, তাহলে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন হতো। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করত। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন হতো। জনগণ যখন যে দলকে ভোট দিত সেই দল ক্ষমতায় যেত। ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না করলে জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে অন্য দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাত। এই চর্চা থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংশোধন হওয়ার সুস্থ প্রতিযোগিতা চলত! জনগণেরও রাজনৈতিক দলের কাছে মূল্য থাকত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনই কলুষিত হলো হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মাধ্যমে। সেই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাসদ প্রায় সবকটি আসনেই অংশগ্রহণ করে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হতো তাহলে জাসদ ১০-১৫টি আসনে জয়লাভ করত কি না, সন্দেহ ছিল। যার দ্বারা সরকার পরিবর্তন তো দূরের কথা, শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করা ছিল দুঃসাধ্য! অথচ সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথে প্রথম পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো। পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, বাকশাল গঠন; পরিণামে ৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ইতিহাস আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুধু ব্যাহতই করেনি, আরও কণ্টকাকীর্ণ করেছে। স্বৈরশাসক এরশাদ পতনের পর নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার সংযোজন গণতান্ত্রিক চর্চাকে কিছুটা আলোর মুখ দেখালেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সেই পথকে শুধু আটকেই দেয়নি, স্বৈরশাসক তৈরির দরজা আরও উন্মোচন করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ জুলাই মাসে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতন।

পরিবর্তিত অবস্থায় এখন প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল প্রকার শোষণ-পীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ উপহার দেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে আমূল সংস্কার, যা শুধু জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সরকারই করতে পারবে। বর্তমান সরকারকে বিষয়টি মাথায় রেখেই এগোতে হবে। রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কার ছাড়া সরকারকে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল লাভবান হয়। বর্তমান কাঠামোয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমেও যদি সরকার পরিবর্তন হয়, তাহলে নতুন স্বৈরাচারের যে জন্ম হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? অতএব, রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ উন্মুক্ত করার পথ এ সরকারকেই তৈরি করতে হবে। এজন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকু সময় দিতে জনগণ প্রস্তুত। সংবিধানের দোহাই দিয়ে যদি স্বৈরশাসক তৈরি এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে তবে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাময়িকভাবে সংবিধান স্থগিত থাকলে ক্ষতি কী?

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক অধ্যক্ষ

সরকারি রাশিদাজ্জোহা মহিলা কলেজ, সিরাজগঞ্জ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসএমসিতে চাকরির সুযোগ, আজই আবেদন করুন

সিদ্ধিরগঞ্জে বিস্ফোরণে নাতির পর নানির মৃত্যু

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন আজ

আজ ঢাকার আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

২৬ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু আজ

তিন সহযোগীসহ ‘মাদক সম্রাট’ শাওন গ্রেপ্তার

ফের সৈকতে ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২৬ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

পাঁচ বাংলাদেশিকে ফেরত দিল বিএসএফ

১১

ক্ষমতায় গেলে এক কোটি কর্মসংস্থান করবে বিএনপি : টুকু

১২

ড. ইউনুস কি ভালো ভোট করতে পারবেন : মান্না

১৩

ষড়যন্ত্রকারীদের সতর্কবার্তা দিলেন আমিনুল হক

১৪

স্ত্রী-সন্তানসহ প্রবাসীর মৃত্যু, চাচাতো চাচা রফিকুল রিমান্ডে 

১৫

জবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা মনিটরিং সিস্টেম চালু ১ সেপ্টেম্বর

১৬

স্থপতি মোশতাক আহমেদের বাবার মৃত্যুতে রাজউক চেয়ারম্যানের শোক

১৭

আফ্রিদির বিরুদ্ধে মামলার হুঁশিয়ারি, উকিল খুঁজছেন স্বপন

১৮

মুন্সিগঞ্জে ‘গত আগস্টে লুট করা অস্ত্র’ দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা

১৯

গরিবের স্বপ্নেই থাকে ইলিশ

২০
X