বাজারে পণ্য কিনতে গেলে মানুষ সবসময় সবচেয়ে ভালোটিই পেতে চায়। মানুষের এ অভ্যাস সহজাত। কেননা, ভালো বা উৎকৃষ্ট জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। পচা বা নষ্ট হয়ে যাওয়া পণ্য কেউ কিনতে চায় না, খাওয়া তো দূরের কথা। তারপরও মানুষ অনেক সময় প্রতারিত হয়ে নিকৃষ্ট পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। অসাধু ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা ক্রেতার চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিকৃষ্ট বা নিম্নমানের পণ্য গছিয়ে দিয়ে থাকে। আসল পণ্যের সঙ্গে নকল বা নিম্নমানের পণ্য মিশিয়ে আসল বলে চালিয়ে দেয়। ক্রেতার কাছে পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের তাৎক্ষণিক সুযোগ না থাকায় তারা প্রতারিত হন। বিদেশে থাকেন এমন বন্ধুরা বলেন, ওসব দেশে দোকানে গিয়ে ‘পিওর’ বা খাঁটি জিনিস চাইলে দোকানিরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। পণ্যের আবার ‘আসল-মেকি’ বা ‘উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টের’ প্রকারভেদ হতে পারে, এটা তারা জানেনই না। ঘি মানে তাদের কাছে ঘি। সেখানে খাঁটি-ভেজালের কোনো বিষয় নেই। তা ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে পণ্যে ভেজাল মেশানো মানুষ হত্যার সমপর্যায়ের অপরাধ হিসেইে গণ্য। ফলে বাজারে খাঁটি পণ্যটিই পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে খাঁটি পণ্য পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত সবখানেই ভেজালের দৌরাত্ম্য। এই ভেজাল মোকাবিলা বা এর হোতাদের দমনের জন্য আইন আছে, কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু সেই আইনের তেমন প্রয়োগ নেই। মাঝেমধ্যে আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে কর্তৃপক্ষের নকল-ভেজাল পণ্যের কারখানা, গোডাউন আবিষ্কারের খবর আসে গণমাধ্যমে। কারখানা-গোডাউন সিলগালা হয়, ভেজাল কারবারিরা কখনো কখনো গ্রেপ্তারও হয়। তবে বেশিরভাগ সময় উড়াল দেয় চড়ুই পাখির মতো। এ নিয়ে মিডিয়া সরগরম হয়, পত্রিকায় কলাম বেরোয়, টিভি টকশোয় ঝড় ওঠে। তারপর একসময় সব সুনসান। আর কোনো সাড়াশব্দ থাকে না। সবকিছু চলতে থাকে ‘যথা পূর্বং, তথা পরং’।
আচ্ছা, বাজারের পণ্যের মতো গণতন্ত্রেরও কি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট প্রকারভেদ আছে? না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল কেন বললেন, ‘উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন করলেই হবে না, ফ্যাসিবাদ যেন গড়ে না ওঠে, সেজন্য কিছু সংস্কার করতে হবে।’ গত ২৪ অক্টোবর বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় কথাগুলো বলেছেন তিনি। একই আলোচনা সভায় ড. আলী রীয়াজ, যিনি আমাদের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান, বলেছেন—‘রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না; তবে আপনি, আমি তৈরি করতে পারি। প্রতিষ্ঠান শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। যদি গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাহলে বহুদলের কথা বলতে হবে। এত বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন, সেখানে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে এমন কোনো পরিবর্তন দেখেছেন যে তারা নিজেরা পরিবর্তিত হতে চাচ্ছে?’ আলী রীয়াজ অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি সেটা দেখেননি। তিনি বলেছেন, ‘আপনি সংবিধান সংস্কার করবেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার করবেন কি করবেন না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তার প্রথম পদক্ষেপই না নেয়, তাহলে কী আশা করবেন? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ রিয়েলাইজেশন নেই যে, তাকেও পরিবর্তন হতে হবে।’ (কালবেলা, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪)।
ড. আসিফ নজরুল আর ড. আলী রীয়াজের বক্তব্যের মধ্যে তফাত খুব কম। আসিফ নজরুল উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের কথা বলেছেন আর আলী রীয়াজ বলেছেন সে গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের অপরিহার্যতা এবং তাদের মধ্যে পরিবর্তনের কথা। একটি আরেকটি পরিপূরক। এখন উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝব? ধরে নেওয়া যায়, যে গণতন্ত্রে জনগণের ভোটাধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকে, রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রবে সভা-সমাবেশ ও তৎপরতা চালাতে পারে, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা থাকে, সেটাকে আমরা উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় ফেলতে পারি। এর পরেই প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে, আমরা কখনোও কি সেই গণতন্ত্রের দেখা পেয়েছি? আমার মনে হয় না, এ প্রশ্নের জবাবে কেউ হ্যাঁ বলবেন। কেননা, পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র যেমন অধরা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তা একরকম সোনার হরিণ হয়েই আছে। অবশ্য বাংলাদেশের আকাশে গণতন্ত্রের সূর্য একেবারে মুখ দেখায়নি এটা বলা যাবে না। স্বৈরতন্ত্র আর কর্তৃত্ববাদের মেঘের আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে সে সূর্যটি উঁকি দিয়েছে। এ যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বাস্তব রূপ—‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না/ কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।’ চুয়ান্ন বছরের ইতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে কবিগুরুর গানের বাণী আর আমাদের গণতন্ত্রের আসা-যাওয়ার সাজুয্য অনুধাবন করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। একই সঙ্গে ড. আসিফ নজরুলের মন্তব্যের যথার্থতা নিয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়। এতদিন আমরা গণতন্ত্রের নামে যা কিছু ভক্ষণ করেছি তা মোটেই উৎকৃষ্ট ছিল না। রাজনৈতিক সরকারগুলো সেই ভেজালমিশ্রিত গণতন্ত্র আমাদের খেতে বাধ্য করেছে। নিরুপায় আমরা মাথা নিচু করে সে পাম অয়েল মিশ্রিত ‘খাঁটি ঘিয়ে’ রান্না করা খাবার মুখে গুঁজে ‘চমৎকার খানা’ বলে কৃত্রিম তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। দূর অতীতে যাওয়ার দরকার নেই। এই যে পনেরো বছরের মুদ্দত আমরা পার করে এলাম, সেখানে কি গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও ছিল? অথচ গণতন্ত্রের একটি লেবেল আঁটা ছিল।
দেশে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা। কেননা, রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসে রাজনৈতিক দল। কিন্তু এটা প্রমাণিত, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ততটুকু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যতটুকু তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকতে প্রয়োজন। হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের যে দাবিটি অবিসংবাদিত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, তা হলো—রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার তা শুরু করেছে। কিন্তু তা সম্পন্ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতার বিকল্প নেই। এ বিষয়ে নির্মম সত্যটি ড. আলী রীয়াজ উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এত বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে পরিবর্তন হলো, অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তারা যে পরিবর্তিত হতে চায়, তাও বোঝা যাচ্ছে না। এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি আলী রীয়াজ। রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় এটা আর এখন লুকোনো নেই যে, রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার নয়, তাদের মূল লক্ষ্য হলো যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়া। এজন্যই তারা বলতে শুরু করেছেন রাষ্ট্র সংস্কার ‘নির্বাচিত’ সংসদ করবে, এটা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। তার অর্থ হলো, সংস্কারের দরকার নেই, দ্রুত নির্বাচন দাও। এমনকি তারা প্রয়োজনে আন্দোলনে নামারও প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছে!
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে। গত ২৪ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন না হলে বিএনপি ঘরে বসে চীনাবাদাম খাবে না।’ অন্যদিকে গত ১৫ অক্টোবর ঢাকায় একটি সাইনবোর্ড-সর্বস্ব রাজনৈতিক দলের আলোচনা সভায় ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মদদে বনে যাওয়া বিএনপির ‘অস্থায়ী মহাসচিব’ বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য এক বছরই যথেষ্ট। তার মতে, ড. ইউনূসের ক্ষমতালিপ্সা না থাকলেও তার উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন, তাদের কারও কারও আজীবন ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা আছে। মেজর হাফিজ প্রশ্ন তুলেছেন, সংস্কারের জন্য কত সময় লাগতে পারে? আর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট এ সরকারকে জনগণ দিয়েছে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বিএনপি নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসছে। এ থেকে ড. আলী রীয়াজের মন্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করা যায়। সত্যিকার অর্থেই দেশে একটি বিপ্লবাত্মক গণআন্দোলন এবং তার ফলে একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা এখনো নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ নিষ্কণ্টক করাকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রধান ধাপ হিসেবে মনে করছে। তাদের এ মনোভাব যে জনগণের প্রত্যাশা ও ভাবনা-চিন্তার বিপরীত, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই, বরং স্বাভাবিক। তবে তা হতে হবে জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কেননা, রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে যদি জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে তা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেল সে ধরনের ক্ষমতাকে বলেছেন ‘নগ্ন ক্ষমতা’। তিনি তার গ্রন্থ ‘ক্ষমতা’য় বলেছেন, ‘আমি কোনো ক্ষমতাকে নগ্ন বলি, যখন এটি কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীসমূহের ক্ষমতার প্রতি মোহের প্রবণতার ফলশ্রুতি হিসেবে আসে, আর এর অনুসারীদের কাছ থেকে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আদায় করে আনুগত্য, সক্রিয় সহযোগিতা নয়।’
এই নগ্ন ক্ষমতার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া অনাবশ্যক। কেননা, এ দেশটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে তারা ক্ষমতাসীনদের নগ্ন ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে আসছে। কখনো ‘লাল ঘোড়ার’ ক্ষুরের আঘাতে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আবার কখনো ‘সন্ত্রাসের গডফাদারদের’ উদ্বাহু নৃত্য দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। ক্ষমতার এই নগ্ন ব্যবহারের সবচেয়ে ভরা মৌসুম গেছে গত সরকারের তিনটি মেয়াদ। একটি সরকার তার ক্ষমতাকে কতটা কদর্যভাবে ব্যবহার করে পরমত দমন ও জনগণের মৌলিক অধিকার পদদলিত করতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে ওই সময়ে; যা ইতিহাসে নিকৃষ্ট শাসন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
সেজন্যই দেশবাসীর একান্ত চাওয়া, রাষ্ট্রকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে ক্ষমতায় গিয়ে কোনো সরকার স্বৈরাচারের রূপ পরিগ্রহ করতে না পারে। আর তা করতে হলে একটি উৎকৃষ্টমানের গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করা অপরিহার্য। সে পথ যদি উন্মুক্ত করা না যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে জনগণকে নিকৃষ্ট শাসন উপহার দিতে দ্বিধা করবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক