বুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ড. ইকবাল আহমেদ
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ক্রিপ্টোকারেন্সি—অর্থনীতিতে নতুন বিপ্লব

ক্রিপ্টোকারেন্সি—অর্থনীতিতে নতুন বিপ্লব

বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যার মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। এটি একটি ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকৃত (Decentralized) এবং নিরাপদ উপায়ে পরিচালিত হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রথমত বিকেন্দ্রীকৃত ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে প্রবর্তিত হলেও এখন এটি আর্থিক খাতে এক বিস্তৃত দিগন্ত খুলে দিয়েছে। গণ্য হচ্ছে আর্থিক লেনদেনের ভবিষ্যৎ হিসেবে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ক্রিপ্টো বলতে কী বোঝায়: ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রযুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত। এটি সাধারণ মুদ্রার মতো সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় বরং একটি বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন গোপনীয় ও নিরাপদ রাখতে ক্রিপ্টোগ্রাফির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। এটি ব্লকচেইন নামে পরিচিত একটি ডাটাবেজ প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেনগুলোকে নিশ্চিত ও সংরক্ষণ করে। জনপ্রিয় কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপল ও লাইটকয়েন রয়েছে। আর বিটকয়েন হলো বিশ্বের প্রথম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা ২০০৯ সালে সতোশি নাকামোতো নামক ছদ্মনামের একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। বিটকয়েনের সাফল্যের ফলে ইথেরিয়াম, রিপল, লাইটকয়েনসহ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভব ঘটে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি কীভাবে কাজ করে: ক্রিপ্টোকারেন্সি কাজ করে ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে, যেখানে প্রতিটি লেনদেন একটি ব্লকে সংরক্ষণ করা হয়। ব্লকচেইন হলো একটি সার্বজনীন, ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার বা লেনদেন রেকর্ড, যা নেটওয়ার্কের প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দ্বারা দেখা যায়। যখনই একটি লেনদেন ঘটে, এটি ব্লক আকারে ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা হয় এবং প্রতিটি ব্লক চেইনের একটি লিঙ্কের মাধ্যমে পরবর্তী ব্লকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং জালিয়াতি প্রতিরোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ একটি বিটকয়েন অন্য কাউকে পাঠায়, তখন লেনদেনটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাচাই করা হয় এবং ব্লকচেইনের নতুন একটি ব্লকে যোগ করা হয়। এর ফলে ব্লকচেইনে প্রতিটি লেনদেনের একটি সার্বজনীন রেকর্ড তৈরি হয়, যা সব অংশগ্রহণকারী দেখতে পায়। তবে এতে ব্যক্তিগত তথ্য গোপন থাকে, শুধু লেনদেনের তথ্য দেখানো হয়, যা লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

উন্নত দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি তথা বিটকয়েন প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে চালু হয়। প্রথমদিকে এটি শুধু অনলাইন গেমার এবং প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে ২০১০ সালের দিকে বিটকয়েন প্রথমবারের মতো একটি পণ্যের মূল্য পরিশোধে ব্যবহার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র: ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো বিটকয়েন একটি বাস্তব পণ্যের বিনিময়ে ব্যবহার হয়, যেখানে একজন বিটকয়েন ব্যবহারকারী ১০,০০০ বিটকয়েন দিয়ে একটি পিজ্জা ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে বিটকয়েনের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে এটিএম মেশিনে বিটকয়েন তোলা ও ব্যবহার করা সম্ভব।

জাপান: জাপান ২০১৭ সালে বিটকয়েনকে বৈধ পেমেন্ট পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এখন জাপানের অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিটকয়েনকে পেমেন্ট পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করে। জাপানের অর্থনীতিতে বিটকয়েনের প্রভাব ইতিবাচক বলে মনে করা হয় এবং এটি বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোয় এর ব্যবহার, সুবিধা ও প্রভাব: এককথায়, উন্নত দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত এবং বিনিয়োগ খাতে বিস্তৃত। এ ছাড়াও—

১. বিকেন্দ্রীকৃত লেনদেন: ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থা, যা দ্রুত এবং স্বল্প খরচে লেনদেন করার সুযোগ দেয়।

২. আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজতর: ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ছাড়াই দ্রুত লেনদেন করা যায়, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক।

৩. নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা: ব্লকচেইন প্রযুক্তির কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিরাপদ ও গোপনীয়, যা ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

৪. বিনিয়োগের বিকল্প পদ্ধতি: উন্নত দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি লাভজনক বিনিয়োগ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা আর্থিক খাতে নতুন এক উদ্দীপনা যোগ করেছে।

৫. ট্রেডিং মার্কেট: ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নিজস্ব একটি ট্রেডিং মার্কেট গড়ে উঠেছে, যা অনলাইন এবং অফলাইন প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের সুযোগ দেয়।

৬. উন্নত প্রযুক্তির প্রসার: ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রযুক্তিগত চাহিদা উন্নত দেশে গবেষণা ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে, যা অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নয়নের সহায়ক।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এর উপযোগিতা: বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার এখনো সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও, এর সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার, আইটি কর্মী এবং উদ্ভাবনমূলক উদ্যোক্তাদের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার হতে পারে অর্থনৈতিক উন্নতির একটি অন্যতম মাধ্যম।

১. অনলাইন বাণিজ্য ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সহায়ক: বাংলাদেশের হাজারো ফ্রিল্যান্সার ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারেন, যা তাদের আয়ের সুরক্ষা দিতে পারে।

২. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ: বাংলাদেশের স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ সহজতর হতে পারে।

৩. ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়াই অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি: দেশের অনেক মানুষ এখনো ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে তারা সরাসরি লেনদেন করতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো সমাধান করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হতে পারে।

১. আইনি সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশে এখনো ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ এবং আইনগত স্বীকৃতি নেই। এ কারণে ব্যবহারকারীরা অবৈধ কার্যকলাপের ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। সরকারি পর্যায়ে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে, যা বৈধভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকে স্বীকৃতি দেবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে।

২. নিরাপত্তার ঝুঁকি: ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে জালিয়াতি এবং হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি রয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের জন্য একটি বড় উদ্বেগ। উন্নত সাইবার সুরক্ষা প্রযুক্তি এবং নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যেতে পারে।

৩. প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব: বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির জ্ঞান সীমিত। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষামূলক কার্যক্রম ও কর্মশালার আয়োজন করে জনগণের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ব্লকচেইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি তথা বিটকয়েন বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যা তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে সহায়ক হতে পারে। তবে আইনি নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নীতিমালা গড়ে তোলা হলে বাংলাদেশেও ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কী সিদ্ধান্ত নিলেন, জাতিকে জানান : রাশেদ খাঁন

জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার খোঁজ নিল ডিএমপি কমিশনারের প্রতিনিধি দল

দেশের আকাশে চক্কর দিয়ে গেল ভারতের তিনটি ড্রোন

দ্রুত ডাকসুর ঘোষণা না আসলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি শিবিরের

অগ্রণী ব্যাংক ও ব্রাকনেটের মধ্যে প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত

সচিবালয়ে প্রবেশে বাধা অনাকাঙ্ক্ষিত : ইউট্যাব

সাবেক ভূমিমন্ত্রীকে বাসায় পাঠিয়ে দিল পুলিশ

আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা চরমোনাই পীরের

আর কোনো তালবাহানা নয়, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে : খোকন

পুরোনো ভুল থেকে শিখতে চান লিটন

১০

নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনায় মহিলা পরিষদের উদ্বেগ 

১১

সম্মেলন ছাড়াই লক্ষ্মীপুরে ছাত্রদলের ১০ কমিটি

১২

আলোচনা সভায় বক্তারা / ১০ মাসেও সরকারের মনের কথা বোঝা যাচ্ছে না

১৩

রাজশাহীতে পরিত্যক্ত ‘রকেট লঞ্চার’ উদ্ধার

১৪

সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তারের পর সেনা সদরের বার্তা

১৫

বগুড়ায় মিডিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন শহীদ শিমুল একাদশ

১৬

সুব্রত বাইনের উত্থান কীভাবে

১৭

রাবিতে এটিএম আজহারের মুক্তির প্রতিবাদে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের মশাল মিছিলে হামলা

১৮

ভারতীয় পুশইনের ক্ষেত্রে নীরব অন্তর্বর্তী সরকার : ১২ দলীয় জোট

১৯

ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে বক্তব্য দিতে পারেন খালেদা জিয়া

২০
X