বিগত ১৫ বছর আওয়ামী সরকারের শাসনামলে দেশ থেকে অবৈধভাবে ২৪ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয় প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংস, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলের অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা তছরুপসহ অসংখ্য অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা সংঘটিত হয়। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও মানুষের জীবনের ওপর এসবের কুপ্রভাব ও ফলসহ বেশ কিছু করণীয় বা সুপারিশের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্রে। গত রোববার সংশ্লিষ্ট কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। এ চিত্র নিঃসন্দেহে বিগত শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন ও অপশাসনেরই সাক্ষ্য বহন করে।
চলতি বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতন হয়। ওই মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার সম্ভব হয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ কেলেঙ্কারি এবং অনিয়মিত ঋণের মাধ্যমে। আর এ পাচার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে। প্রতিবেদন বলছে, দেশের উন্নয়নের আখ্যান ভঙ্গুর ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে, যা পদ্ধতিগত দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের দ্বারা জর্জরিত। দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপির যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. ইউনূস বলেন, এ প্রতিবেদন একটা ঐতিহাসিক দলিল। আর্থিক খাতে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর দশায় আমরা পেয়েছি, তা এ রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতি এ নথি থেকে উপকৃত হবে। কমিটির প্রধান বলেন, ৩০টি অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কীভাবে চামচা পুঁজিবাদ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, কীভাবে তারা নীতি প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রতিবেদনে কীভাবে এবং কোথায় অর্থ পাচার হয়েছে—সেই তথ্যও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
আমরা মনে করি, কোনো দেশের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সামান্যতম দেশপ্রেম থাকলে দেশের অর্থ, দেশের সম্পদ নিয়ে এমন নজিরবিহীন দুর্বৃত্তপনা সম্ভব নয়। মানুষের সম্পদ চুরি ও পাচার করে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সম্ভব নয়। তবে বাস্তবে এমটাই ঘটেছে। সম্প্রতি ইউএনডিপির এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আবার সেই দেশের মানুষই চুরি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার করে অন্য দেশে ধনীর তালিকায় নাম লেখায়। কেউ কেনে শত শত বাড়ি। গড়ে তোলে বড় বড় ব্যবসা। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। দেশপ্রেম থাকলে এসব সম্ভব?
আমরা জানি না কবে এ দেশের মানুষের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে; একটি ন্যায়সংগত সমাজ তৈরি হবে। তবে আমাদের বিশ্বাস, একদিন দুর্নীতিমুক্ত বৈষম্যহীন ও সবার জন্য কল্যাণের সমাজ অবশ্যই গড়ে উঠবে। আমাদের প্রত্যাশা, দুর্নীতি ও পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র কমিটির সুপারিশগুলো বিবেচনাসহ পাচার অর্থ দেশে ফেরানোয় সংশ্লিষ্টরা তৎপর হবেন।