ব্যক্তি জীবনে যেমন চাহিদার শেষ নেই, রাষ্ট্রীয় জীবনেও উন্নয়ন হলো আপেক্ষিক ও অসীম একটি ধারণা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি হলো অনেকটাই অনুকরণীয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর শুধু আর্থিক সূচকের কাগুজে ঊর্ধ্বগতি আর অবকাঠামো খাতের চাকচিক্যকে, উন্নয়নের মডেল হিসেবে উপস্থাপনের কী খেসারত হতে পারে, তার উদাহরণ বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তায় শুধু অবকাঠামো যেন একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। দৃশ্যমান এসব কিছু প্রকল্প লাভজনক ও জনদুর্ভোগ লাঘব হলেও অনেক বড় বড় প্রকল্পই এখন অপ্রয়োজনীয় ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া এসব প্রকল্পের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অধিক হওয়ায় রয়েছে বড় আর্থিক দুর্নীতির অভিযাগ। এসব অবকাঠামোগত ব্যয়ে বাংলাদেশ যে ঋণ নিয়েছে, তার পরিমাণ বর্তমানে সাত বছরে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ২০১৭ সালে ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে দাঁড়িয়েছে ১০০.৬৩। ফলে বাংলাদেশ এখন যে ঋণ করছে, তার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে পূর্বের ঋণ পরিশোধে। অন্যদিক ব্যাংক খাত থেকে নামে-বেনামে উত্তোলিত কোটি কোটি ঋণের অর্থে দৃশ্যমান কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও দেশের অর্থনীতির সূচকে উন্নয়নের গ্রাফের যে মিথ তৈরি করা হয়েছে, তার ভেতরটাও ছিল ফাঁপা। কারসাজি করে উন্নয়নের উল্টো পিঠকে সাময়িকভাবে ঢেকে রাখলেও এর কুফলগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং ও অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলোকে দুর্বল করে ফেলছে। এজন্য দেশের সার্বিক উন্নয়নে শর্টকাট পথে না হেঁটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। এজন্য আমাদের প্রয়োজন নিজস্ব সামর্থ্য, সক্ষমতা এবং ধারাবাহিকভাবে অগ্রসরমাণ পরিকল্পনাকে বিবেচনায় নিয়ে আদর্শ পরিস্থিতিতে পৌঁছানো।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তিনটি বড় উৎস হলো পণ্য রপ্তানি, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ। তার মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমে।বিগত দিনে ক্ষমতাসীনদের একটি দর্শন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী ছিল যে, অবকাঠামো হলেই উন্নয়ন হয়ে যাবে। কিন্তু অবকাঠামোর সুফল নিশ্চিতে প্রয়োজন সম্পূরক পদক্ষেপ। উদাহরণস্বরূপ যমুনা সেতুর কারণে কৃষিপণ্যের উন্নতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা উত্তরবঙ্গের মঙ্গা তথা দারিদ্র্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য ব্যবস্থার সংকটে এ অঞ্চলে শিল্প-কারখানা বা অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত বিকশিত হয়নি। যমুনা সেতু চালুর ২৪ বছরের এই ফল পর্যালোচনা করে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার। কৃষিক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি এখন দক্ষিণবঙ্গেও সবুজ বিপ্লবের ছবি ফুটে উঠেছে। তবে এ অঞ্চলের আবহাওয়া অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতির চিন্তা করতে হবে। সময়ের পরিবর্তনে উন্নয়নের ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সমতা, পরিবেশগত সংরক্ষণ, মানবাধিকার এবং স্থায়িত্বের বৃহত্তর মাত্রা দাবি করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের উন্নতির নিজস্ব নীতি প্রণয়নে কঠোরভাবে দাঁড়াতে হবে। সার্বিক উন্নয়নে ক্রমাগত সরকারি ভর্তুকি দিয়ে, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং শিল্পের মেরুদণ্ড তৈরি করার ও কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একটি কার্যকর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি।
লেখক: তালুকদার মঞ্জুর এলাহী, ব্যাংকার