জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন দার্শনিকও। তার চিন্তাচেতনা ও দর্শন ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল করা। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। এর পরপরই সেন্টমার্টিন দ্বীপসংলগ্ন ১২ মাইল এলাকাজুড়ে ‘টেরিটোরিয়াল সি’ অঞ্চল গঠনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আগে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক চিন্তা কেউ করেনি!
বিশ্বের কোনো দেশে এ ধরনের আইনও ছিল না। ১৯৮২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রণয়ন করা আইন জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সমুদ্র সম্পদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শুধু চিন্তাই করেননি, তা আহরণের জন্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। এর ২০ বছর পর বেলজিয়ামের নাগরিক গুল্টার পাউলি গবেষণার মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে সমুদ্র সম্পদ সংক্রান্ত তার ধারণা তুলে ধরেছেন (যা ২০১২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা [এসডিজি] সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে স্বীকৃতি পায়)। তখন থেকে সমুদ্র অঞ্চলের দেশগুলো সমুদ্র সম্পদ আহরণে নজর দেয়।
রাজনীতিবিদ, দার্শনিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেধা ও দূরদৃষ্টি এতটাই প্রখর ছিল যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ‘টেরিটোরিয়াল সি’ গঠন করেছিলেন। জাতির পিতা শুধু ‘টেরিটোরিয়াল সি’ অঞ্চল গঠন করে ক্ষান্ত হননি, সমুদ্রে থাকা অফুরন্ত সম্পদ আহরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে ব্লু ইকোনমির ওপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রা রুখে দিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে নিমজ্জিত, অর্ধনিমজ্জিত জাহাজ এবং মাইন অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এসব অপসারণ করে চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাশিয়া সরকারের সহায়তা কামনা করেন। রাশিয়া সরকার একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে নিমজ্জিত, অর্ধনিমজ্জিত জাহাজ এবং অবিস্ফোরিত মাইন উদ্ধার করে। পরবর্তীকালে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাশিয়া সরকারের কাছে সহায়তা চান। রাশিয়া সরকার ১৯৭৩ সালে লোকবলসহ ১০টি মৎস্য আহরণের জন্য ট্রলার প্রদান করে। বাংলাদেশ যাতে নিজস্ব নাবিকের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ করতে পারে, তার জন্য রাশিয়ার কারিগরি সহযোগিতায় মেরিন ফিশারিজ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে ১৯টি জাহাজ সংযোজন করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনারও পিতার মতো মেধা ও দূরদৃষ্টি রয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বঙ্গোপসাগরের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল-গ্যাসসহ অসংখ্য খনিজসম্পদ মজুত রয়েছে, যা আগামী দিনের জ্বালানি রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ সীমানায় ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিকরন, গার্নেট, ম্যাগটাইট, মোনাজাইট, কোবাল্টসহ বিভিন্ন ভারী খনিজসম্পদের পাশাপাশি ৪৭৫ প্রজাতির মৎস্য রয়েছে, যা আহরণ এবং রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সে কারণে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন জাতিসংঘের আনক্লোস আইনটি অনুসমর্থন করেন। ফলে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ৩৫০ মাইলব্যাপী মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে উত্থাপনের দায় সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণে আইনি লড়াই শুরু করে। অবশেষে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের ৮০ দশমিক ৫১ শতাংশ। এটি যেন বঙ্গোপসাগরের বুকে আরেক বাংলাদেশ! বাংলাদেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান, তার সমপরিমাণ সম্পদ সমুদ্র তলদেশে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চৌকস নেতৃত্বাধীন সরকার ব্লু ইকোনমির সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে মেরিন ও মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথম এবং একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ব্লু ইকোনমি অর্জনের লক্ষ্যে মেরিটাইম বিষয়ক উচ্চতর পড়াশোনার জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম ‘বিশেষায়িত’ বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি এখান থেকে মেরিন ক্যাডেটদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ‘ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স’ ডিগ্রি দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি রাজধানীর মিরপুর অস্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে থেকে চট্টগ্রামের বাকলিয়া হামিদচরে ১০৬.৬ একর জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট আইন পাস, ২০১৭ সালে ইনস্টিটিউটের প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হয়। প্রায় ৪০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বমানের বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লু ইকোনমি বিষয়ক অনুষদ স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কক্সবাজারে গবেষণাকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এলাকা পায়রা, খুলনা, ভোলা, বরিশাল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মিরসরাই এলাকার সমুদ্র অঞ্চল কেন্দ্র করে শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। নির্মাণ করা হয়েছে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন ও মেরিন ড্রাইভ। বৃদ্ধি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দরের সক্ষমতা। এ ছাড়া মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ-সবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির ফসল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বঙ্গোপসাগর থেকে সমুদ্র সম্পদ আহরণের যে কালজয়ী চিন্তা করেছেন, তা বিকল্প অর্থনীতির মাইলফলক। বাংলাদেশ সমুদ্র সম্পদ আহরণে যত বেশি মনোযোগী হবে, দেশের অর্থনীতির ভিত তত বেশি মজবুত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : সমসাময়িক রাজনীতি বিশ্লেষক ও ব্লু ইকোনমিবিষয়ক গবেষক, সম্পাদক, বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ), সভাপতি, বাংলাদেশ বাঙ্কার সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ফেনী জেলা।
মন্তব্য করুন