চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আয়কর, মূসক বা ভ্যাট ও শুল্ক আদায়ে ঘাটতি বেড়েই চলছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রবৃদ্ধি যথারীতি ঋণাত্মক (-১.০৩ শতাংশ)। যেখানে প্রথম তিন মাসে তিন বিভাগে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশ সবচেয়ে সংকট সময় অতিক্রম করছে। সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় করা যায়নি। সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে আশা করছি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, তিন মাসের মধ্যে অর্থবছরের জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরের মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা করে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।
আর সর্বশেষ অক্টোবর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ঘাটতি ৮ হাজার ৫৪১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি মাসেই রাজস্ব আদায় থেকে পিছিয়ে পড়ছে এনবিআর।
খাতভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রথম চার মাসে আয়কর খাতেই ঘাটতি হয়েছে ১৩ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। এ খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪৫ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ৩১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১.৭৮ শতাংশ।
অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানি খাতে চার মাসে ৩৯ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ খাতে ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৯৬০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি ০.৮৩ শতাংশ।
গত জুলাই-অক্টোবরে ভ্যাট বা মূসক আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার ৫০৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ওই সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ৭২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ সময়ে এ খাতের লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৪.৮৮ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য উৎস হতে ৬১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আয়কর, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর থেকে আসবে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি, সম্পূরক শুল্ক ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি, রপ্তানি শুল্ক ৭০ কোটি, ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও অন্যান্য কর থেকে আসবে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। গত এক দশকে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। ফলে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক নিচে অবস্থান কছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকেও নিজস্ব সম্পদ-নির্ভর করা যাচ্ছে না। বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে টিআইএনের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লাখ আর এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। টিআইএন সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার। ১০ বছরের ব্যবধানে রাজস্ব আদায় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। অন্যদিকে টিআইএন বেড়ে হয়েছে ছয়গুণ।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে টিআইএন ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার, পাঁচ বছর পর ২০১৮-১৯ অর্থবছর টিআইএন বেড়ে হয় ৪১ লাখ ১৯ হাজার। আর পরের পাঁচ বছরে টিআইএন বেড়ে ১ কোটি ৫ লাখে পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, টিআইএনের মতো রাজস্ব বাড়েনি। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। পরের পাঁচ বছরে বেড়ে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ রাজস্ব আদায় দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৭৮ হাজার টাকা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মতে, বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানোর কারণে মোট দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ না থাকার কারণে এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ও মোট দেশজ উৎপাদনের বড় ধরনের অসংগতি সামনে এসেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে রাজস্ব আদায় হয় জিডিপির ৮ শতাংশেরও নিচে। এ কারণে নিজস্ব সম্পদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না, বিদেশি ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়। আবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নিতে হয়। আগের সরকারগুলোর আমলে সবসময়ই রাজস্ব আদায়ের নানা উদ্যোগের কথা বললেও বা উদ্যোগ নিলেও রাজস্ব আদায়ের গতিতে বড় পরিবর্তন হয়নি। রাজস্ব আদায়ে নতুন সময়-পুরোনো সময় বলে কোনো কথা নেই।
রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি এবং রাজস্ব বোর্ড প্রশাসন, অনুশাসন ও সুশাসনের ওপর। ৫ আগস্টের পর দেশ সোনার খনিতে পরিণত হয়ে গেছে আর রাজস্ব বাড়বে এবং না বাড়লে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, এমন নয়। চেষ্টা চলছে। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। রাজস্ব আদায়ে আগে যেমন ব্যর্থতা ও দক্ষতা ছিল, সে অবস্থায় ধারাবাহিকতা রক্ষা হচ্ছে।
নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হবে—এমন কোনো সুযোগ নেই। আর অর্থনীতি থেকে যে রাজস্ব আদায় হবে, অর্থনীতি তো সেভাবে চাঙ্গা হয়নি বা হচ্ছে না। কিংবা চাঙ্গা হওয়ার পথে রয়েছে নানা সমস্যা। তা ছাড়া দুই মাস ধরে একটি আন্দোলন গেল, সেই সময় উৎপাদন সবকিছু বন্ধ ছিল। এতে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। সরকার পতনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে সবকিছু কমে গেছে। তারপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে আমদানি ধীর হয়েছে, রপ্তানিও হয়েছে ধীর।
ব্যাংকগুলো থেকে টাকা লুট হওয়ার কারণে ব্যাংক খাত আর সক্ষমতার সঙ্গে কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সরকারকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে চালাতে হচ্ছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ভালো নেই। অর্থনীতি ভালো না হলে রাজস্ব আদায় করা যাবে না।
লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন