কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫, ০২:২৩ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যে রাজনীতি আমার না সেই রাজনীতি মানি না

যে রাজনীতি আমার না সেই রাজনীতি মানি না

এই রাজনীতি আমার না। এই রাজনীতি আমাদের না। তোমরা ও তোমাদের সবাই যে রাজনীতি করছ, সেই রাজনীতি আমার না। আমাদের না। আমাদের কারোরই না। এ শুধু তোমাদের ক্ষমতার রাজনীতি। তোমরা আমাদের, আমাদের জনগণকে ক্ষমতার জন্য দাবার ঘুঁটি বানাও। ৫৩ বছর অপেক্ষা করছি। আমি, আমরা সবাই তোমাদের ক্ষমতা লাভের পথে গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হলাম। আমাদের অধিকার কোথায়? আমরা কেন তোমাদের কথায় ধারাবাহিকভাবে জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নিলাম? আমাদের হিস্যার কী হলো? আমরা আন্দোলনকারী হলাম, আমরাই বিপ্লবী হলাম, আমরা যোদ্ধা হলাম। আমাদের পরিণাম হলো গুম, খুন আর শাহাদাত। আমরা বিচারের মুখোমুখি হলাম। আমরা জমি হারালাম, ব্যবসা হারালাম, সম্মান হারালাম, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার অধিকার হারালাম। তবুও থামলাম না। আমরা জেলে পচলাম। জেলে থাকায় সন্তানের জন্ম দেখলাম না। বছরের পর বছর ধরে সন্তানের হাসি দেখিনি। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে, চুমু দিতে পারলাম না। আমাদের স্ত্রীরা বিধবা না হয়েও বিধবার মতো জীবনযাপন করল। আমরা তাও মেনে নিলাম, শুধু মানুষের মুখে হাসি ফোটাব বলে। আমি ও আমরা গুম হওয়ায় পরিবারের লোকজন আমাদের সম্পদ সন্তানের কোনো প্রয়োজনেও ব্যবহার করতে পারল না। সন্তান তার বাবাকে মৃত, না জীবিত বলতে পারল না। শুধু তোমাদের ক্ষমতায় আনব বলে। শুধু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করব বলে। ৫৩ বছর ধরে প্রতারিত হচ্ছি। এখনো প্রতারিত হবো?

আমার বাবার হত্যাকারী, বিনা কারণে গর্ভবতী মাকে জেলে আবদ্ধ রেখে যে আমার জন্মটাও জেলখানায় করার ব্যবস্থা করেছিল, তার বিচারের জন্য আমাকে এখনো কাঁদতে হবে? আমাকে এখনো দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে? তোমাদের ক্ষমতার জন্য আমাকে হত্যাকারী, আমার বাবাকে হত্যাকারী, মাকে অসম্মানকারী, বোনকে অসম্মানকারীরা তোমাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সেদিন রাজপথে যে আমার, আমার ভাইয়ের, আমার সহপাঠীর, আমার রাজনৈতিক কর্মীর বুক গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল, সে কি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে? তাকে নিয়ে তুমি ভবিষ্যতের মুক্তির পথ তৈরি করার প্রবঞ্চনা পাচ্ছ? তোমরা আপনজন চিনতে পারছ না? তোমরা তোমাদের জন্য ব্যস্ত? আমার জন্য তোমাদের সময় নেই? তোমরা আনন্দে মেতে রয়েছে? তোমরা কি এখনো ‘আমি’ আর ‘তুমি’র ভাগাভাগিতে ব্যস্ত হয়ে থাকবে?

তোমরা অন্ধ হয়ে আছ নির্দিষ্ট আদর্শে? আমাদের আদর্শ তো একটাই। সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ করা। ক্ষমতায় গিয়ে তোমরা বিপ্লবীরাও আমার সঙ্গে প্রতারণা করবে? তোমরাও কি ক্ষমতার জন্য, তোমাদের ভোগের জন্য আমাদের ভুলে যাবে? আমি কার কাছে মুক্তির স্বপ্ন দেখব? আমি আর স্বপ্ন দেখব না? আমি মুক্তি পাব না? আমি কি তোমার ভোগের কাছে হেরে যাব? আমাদের রক্তের বিছানায় দাঁড়িয়ে, হে বিপ্লবী তুমিও কি আমাকে প্রতারিত করবে? বিপ্লবী, তুমিও আমাকে প্রতারিত করবে? তুমিও ক্ষমতার রাজনীতি করবে? আমি ৫৩ বছর ধরে নানাভাবে ক্ষমতার জন্য প্রতারিত হচ্ছি। আমি জীবনের বাজি রেখেছি। যৌবনের বাজি রেখেছি। সম্পদের বাজি রেখেছি। সন্তানের বাজি ধরেছি। আমি তোমার কথায় রাজপথে এসে আমি কি আমাকেই প্রতারিত করলাম?

’৭১-এ স্বপ্ন দেখেছিলাম। জীবনের বাজি রেখেছিলাম। সদ্য বিবাহত স্ত্রীকে ঘুমন্ত রেখে না বলে পালিয়েছিলাম। সারা রাত ধরে পাহারারত মাকে, তার একটু তন্দ্রা যখন এলো, আমি পালিয়েছিলাম। আমি যুদ্ধে যাব বলে পালিয়েছিলাম। মানুষকে মুক্ত করব বলে তোমার ডাকে সাড়া দিলাম। ক্ষমতায় গিয়ে তুমি আমায় প্রতারিত করলে! আমি তো কোনো দেশের অধীন থাকতে চাইনি। আমি স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলাম। আমি সুন্দর জীবন চেয়েছিলাম আমার প্রিয় সন্তানের জন্য। তুমি আবার আগের শাসকদের মতো দুর্নীতি শুরু করলে। বৈষম্য বাড়িয়ে তুললে। বণ্টনকে রাজনৈতিক আনুগত্যের অধীন করলে। তোমার ক্ষমতার জন্য আমার রাজনীতিকে কলুষিত করলে! তোমার ক্ষমতার জন্য আমার মৃত্যুকে ব্যবহার করলে! আমার দেশ আমার হয়ে উঠল না যে! আমি ও আমরা রক্ত দিলাম। তোমরা সাধু বেশে আমার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করলে। তুমি রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে আমাদের সঙ্গে বেইমান করলে।

আমি আবারও অপেক্ষায় রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম তোমার প্রতারণার প্রতিশোধ নেব বলে। আমার ’৭১-এর অধরা স্বপ্নকে বাস্তব করব বলে। আমি আন্দোলনে গেলাম। আমি আবার রক্তাক্ত হলাম। ঘর ছাড়া হলাম। বাড়ি ছাড়া হলাম। সন্তানকে তার প্রাপ্য আদর থেকে বঞ্চিত করলাম। স্ত্রীকে প্রবোধ দিলাম, আর কয়টা দিন বলে। এবার নিজ দেশের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারের নিপীড়নের তীব্রতা আমাকে হারাতে পারল না। তার নির্মমতা আমার ত্যাগের কাছে হেরে গেল। আমি রাজপথ দখলে নিলাম। আমি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলাম। দেশ মুক্ত হলো। আমি আবার স্বপ্ন দেখলাম তোমার কাছে। আমি মুক্ত হবো আশা করলাম। নির্বাচন এলো। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। তুমি অঙ্গীকার করলে আমাকে মুক্ত করবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারায় এক লম্বা ভ্রমণ শেষে আমি আবার ব্যর্থ হলাম।

নির্মম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও লোভ থেকে তৈরি হল ১/১১। স্বপ্ন নতুন করে সামনে এলো। এবার রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হওয়া থেকে মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন নয়। সুশীলভাবে বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন। সে যে কি হাঁকডাক! কত সংস্কার! কত অধ্যাদেশ! আমি সে আগের মতোই ছিলাম। তোমাকেই সমর্থন দিলাম। আর অল্প কয়দিনের মধ্যে তুমি সুশীলও ব্যর্থ হলে। এই রাজনীতি আবার হাত ছাড়া। রাজনীতি আমার হলো না। আমি নিপীড়িত ও বঞ্চিতই রয়ে গেলাম। এখানেও তুমি তোমার মুক্তির পথ খুঁজলে। আমার নয়, কোনোরকম একটা প্রতারিতভাবে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করে পালালে। আরও স্বার্থপরের মতো নিজেকে মুক্ত করলে। সঙ্গে আমার রাজনীতির ইতিহাসের নির্মমতার সঙ্গে যুক্ত করলে আমার সীমান্ত পাহারাকারী ও আমার প্রিয় সৈনিকদের রক্ত। পিলখানার আশপাশের খালগুলো রক্তাক্ত করলে আমার প্রিয় সৈনিকের রক্তে। নতুন ট্র্যাজেডি!

সুশীল শাসন আমার ভাইয়ের রক্তের ট্র্যাজেডির ওপর আমাকে উপহার দিল এক চরম কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা, যা শেষ হলো এক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায়। আমি এবার চরমভাবে হেরে গেলাম। আমিতো মুক্তি পেলামই না বরং রক্তাক্ত ও আহত অবস্থায় বন্দি হলাম। বাকরুদ্ধ হলাম। চরমভাবে স্বপ্ন হারালাম। হতাশ হলাম। যদিও সামান্য কিছু রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য পেশাজীবী এই চরম রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও মুক্তির জন্য লড়েছে, তাদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা আমাকে চরম হতাশ করল। আমি, আমার ইতিহাস, আমার অর্জন, আমার ৭১ এবার আরও নীতিহীনভাবে ব্যবহৃত হলো ক্ষমতার জন্য। আমি মুক্তির আশা হারিয়ে ফেললাম। হঠাৎ উল্কা বেগে একদল তরুণ এলো। হতাশ রাজনীতিবিদের হাত ধরে, তাদেরই সার্বিক সহযোগিতায় ও অকুণ্ঠ সমর্থনে আমাকে মুক্ত করল। আমি আমাকে ফিরে পেলাম। কিন্তু নতুন জীবন পেলেও, ক্ষমতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগের লোকজনের সুবিধাভোগীরাই রয়ে গেল। আমার আশা যেন ফিকে হয়ে আসছে। আমার স্বপ্ন যেন অধরাই থেকে যাবে! হে তরুণ, তুমি যাদের ওপর নির্ভর করছ, তারা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে কি!

হে রাজনীতি তুমি অন্ধ! তুমি আমার জন্য অন্ধ। তুমি আমাকে পথ দেখাতে পারছ না। তোমাকে বাদ দিতে আমি বিরাজনীতি ও পারিবারিক রাজনীতির বিনাশের দিকে নজর দিলাম; তাতেও আমার মুক্তি তো হলোই না; বরং আমি আরও হতাশ হয়ে পড়লাম। আমি কি আর স্বপ্ন দেখব না? আমি কি মুক্তির স্বপ্ন দেখব না? আমি কি বঞ্চিত থেকেই যাব। হে ২৪-এর বিপ্লবী! তুমি তরুণ বিপ্লবী, তুমি কি আমাকে প্রতারিত করবে? তুমি কাকে পুনর্গঠিত ক্ষমতা-কাঠামোর ভাগ দিচ্ছ? যে আমাকে প্রতারিত করেই চলছিল। যে ৫৩ বছর ধরে আমাকে হতাশ করল। যে ৫৩ বছর ধরে নিজের সুবিধা দেখল, তাকে? যে গত ১৫ বছর একবার আমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে পারল না—‘হে রাজা আমি অত্যাচারিত!’ যার আত্মা অন্ধকারে, মুখ সুবিধার জন্য বন্ধ থাকে। যে তোমাকে প্রতারিত করতে এখন বেশ ধরেছে, তাকে?

হে তরুণ, তুমি যদি আমাকে প্রতারিত করো, আমি আর রাজপথে যাব না, আন্দোলনে যাব না, যুদ্ধে যাব না। আমি আর মুক্তি চাইব না। আমি আর জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নেব না। আমি আর ক্ষমতার জন্য ব্যবহৃত হবো না। আমি এবার তোমারও বিচার চাইব যদি তুমি অপরাধীদের ছেড়ে দাও। যদি তুমি আমার জন্য গণরাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ হও। আমি সবারই বিচার চাইব, যারা আমাকে ৫৩ বছর ধরে প্রতারিত করছ। আমাকে ৭১-এ প্রতারিত করার বিচার। ৯০-এ প্রতারিত করার বিচার। বিচার চাইব ২৪-এর বিপ্লবের পর যারা আমাকে ব্যর্থ করবে। আমরা এ দেশের মানুষরা আর কখনো তোমার পাশে দাঁড়াব না। এই রাজনীতি আমার না। এই রাজনীতি শুধু তোমাকে ক্ষমতায় রাখার, ক্ষমতায় আনার এবং তোমাকে নেতা বানানোর রাজনীতি। এই রাজনীতি আমি মানি না।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভেঙে গেল ৬৩ কোটি টাকার নির্মাণাধীন সেতুর গার্ডার

বাংলাদেশকে ২৪৭ রানে থামানোর পর লঙ্কানদের দুর্দান্ত শুরু

ভিসাপ্রত্যাশীদের জরুরি নির্দেশনা দিল যুক্তরাষ্ট্র

‘কিছু লোক আমাকে ভালো হতে দিল না’

‘ভবিষ্যতে যেন কেউ হুদাই আওয়াল না হয় তার একটা শিক্ষা হতে পারে‘

উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে জবি শিবিরের মৌসুমি ফল উৎসব 

শুরু হচ্ছে ‘ফ্রাইডে নাইট উইথ জায়েদ খান’ 

আশ্বাসে বছর যায়, নদী গিলে খায় জীবনের সবটুকু

আবু সাঈদ হত্যায় মিলেছে ৩০ জনের সম্পৃক্ততা

পুরুষের বন্ধ্যত্ব বাড়াতে পারে যেসব খাবার

১০

গণডাকাতি করে বোমা ফাটিয়ে পালাল ডাকাতরা

১১

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে আরও মুসলিম দেশ?

১২

লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় নারীর গলাকাটা মরদেহ

১৩

মাথায় গুলি ঠেকিয়ে প্রকাশ্যে বিপুল টাকা ছিনতাই

১৪

কমেছে স্বর্ণের দাম, কত টাকা ভরি আজ

১৫

স্ত্রী অল্পতেই রাগছেন? জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ 

১৬

টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫ পর্যটকের কারাদণ্ড

১৭

৪ স্কুলছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগে শিক্ষক গ্রেপ্তার

১৮

রোজা কবে শুরু হতে পারে, জানাল আমিরাত

১৯

‘মহান এই নায়ককে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত’

২০
X