ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আমরা যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মুখ দেখছি; তেমনি সমান্তরালে বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার অপরাধ জটিলতা ও বিস্তৃতি। বিশেষ করে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্ম যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট এবং ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) ভিত্তিক প্রতারণা এখন একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না, বরং সাধারণ মানুষের ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি আস্থাকেও নষ্ট করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন গড়ে ২০০টি সাইবার অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই জড়িত এমএফএস ও ওটিপিভিত্তিক প্রতারণার সঙ্গে। এ প্রতারণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো ফিশিং আক্রমণ। অপরাধীরা ভুয়া এসএমএস, ইমেইল বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়। এসব বার্তায় সাধারণত লেখা থাকে যে, তাদের অ্যাকাউন্টে সমস্যা হয়েছে বা তারা কোনো পুরস্কার জিতেছেন এবং লিঙ্কে ক্লিক করে তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। এই লিঙ্কে ক্লিক করলে ব্যবহারকারী একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন, যেখানে তার ব্যবহারকারী নাম, পাসওয়ার্ড, এমনকি ওটিপিও চুরি হয়ে যায়। অন্যদিকে, ক্লোনড অ্যাপ্লিকেশন (যেমন হুবহু বিকাশের মতো দেখতে অ্যাপ যা গুগল প্লে স্টোরেও পাওয়া যায়) ইনস্টল করলে ব্যবহারকারীর সব তথ্য চুরি হয়ে যায়।
অনেকে আবার ফেসবুকে বিকাশ/নগদ গ্রাহকসেবার নামে ভুয়া পেজ বানিয়ে বিপদে পড়া মানুষের কাছ থেকে ‘সাহায্য’ চেয়ে তথ্য আদায় করে নেয়। এ ছাড়া কল স্পুফিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীরা ব্যাংক বা বিকাশের কর্মী হওয়ার ভান করে গ্রাহকদের ফোন করে। তারা বিভিন্ন অজুহাতে ওটিপি বা পিন নম্বর চেয়ে নেয়। অনেক সময় তারা গ্রাহকদের ভয় দেখায় যে তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে বা জরুরি ভিত্তিতে ট্রানজেকশন বাতিল করতে হবে। এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রেশারের কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অপরাধীদের হাতে তথ্য তুলে দেন। এ সমস্যা বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। তবে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে এখনো অনেক এমএফএস প্রোভাইডার পর্যাপ্ত বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন ছাড়াই লেনদেন অনুমোদন করে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু একটি ওটিপি দিয়েই বড় অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব হচ্ছে, যা নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রবল।
তবে সাইবার অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত ধীরগতি লক্ষ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এ ছাড়া অনেক স্ক্যামার সাধারণত বিদেশি ভিওআইপি কলিং সিস্টেম ব্যবহার করে অথবা বিদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম অপারেট করে, যা তাদের ধরা আরও কঠিন করে তোলে।
সবার আগে কাজ করে সচেতনতার অভাব। অনেকেই এখনো জানেন না যে, ওটিপি বা পিন কাউকে শেয়ার করা উচিত নয়। কিছু ক্ষেত্রে মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে ‘টাকা জেতার’ প্রলোভনে পড়েন এবং ফিশিং লিঙ্কে ক্লিক করেন অথবা পিন নাম্বার স্ক্যামারদের কাছে শেয়ার করে ফেলেন আর বুঝে ওঠার আগেই তাদের টাকা স্ক্যামারের অ্যাকাউন্টে চলে যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। গ্রাহকসেবা যদি আরও শক্তিশালী ও জনবান্ধব হতো, তবে প্রতারণা অনেক কমানো যেত। এমএফএস প্রোভাইডারদের উচিত বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা। ওটিপির পাশাপাশি আঙুলের ছাপ বা ফেসিয়াল রিকগনিশন যুক্ত করা হলে নিরাপত্তা বহুলাংশে বেড়ে যাবে। সন্দেহজনক নম্বরে ট্রানজেকশন ব্লক সিস্টেম চালু করা (AI অ্যালগরিদম দ্বারা চিহ্নিত)। ‘Undo’ ফিচারের বাস্তবায়ন করা যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভুল ট্রানজেকশন ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। পাশাপাশি সরকারের উচিত আইনি ব্যবস্থা জোরদার করা। জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠনে উদ্যোগী হওয়া। শুধু তাই নয়, এ ধরনের সাইবার অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত সাইবার ট্রাইব্যুনাল তৈরি করতে হবে, যাতে এসব অপরাধীর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয় এবং এমন গুরুতর অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি প্রদান সমাজে একটি আদর্শ হয়ে থাকে। পাশাপাশি একটি যুগান্তকারী প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারে যেখান থেকে সন্দেহজনক ট্রানজেকশনে নিজে থেকে অ্যালার্ট তৈরি হয়। প্রতারক মোবাইল নম্বরের কুইক-ডিঅ্যাকটিভেশন সিস্টেম চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। স্কুল-কলেজে সাইবার সিকিউরিটি কোর্স চালু করা যেতে পারে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন তখনই সফল হবে, যখন সাধারণ মানুষ নিরাপদে ডিজিটাল লেনদেন করতে পারবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার, ব্যাংক, টেলিকম অপারেটর এবং সাধারণ নাগরিক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
প্রজ্ঞা দাস, শিক্ষার্থী,
অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ
মন্তব্য করুন