আমাদের দেশে তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নৃশংসতা—এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা নতুন নয়। শনিবার রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে যেসব তথ্য জানা যাচ্ছে, তা ছিল একটি তুচ্ছ ঘটনাই। এদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় তিনি নাকি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষার্থীর দুজন নারী বান্ধবীকে দেখে হেসেছিলেন—এমনটিই অভিযোগ। আর এতেই এক তরুণের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল; অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মমভাবে। সামান্য বিষয়ে এমন মর্মান্তিক ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
শনিবার কালবেলায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে পারভেজ খুনের ঘটনা। ওই দুই তরুণীকে দেখে পারভেজের হাসির বিষয়টি সেদিন প্রক্টর অফিস পর্যন্ত গড়ায়। মিটমাটও হয়। কিন্তু ওইদিন বিকেলে জুনিয়র তিন শিক্ষার্থী তাদের কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে পারভেজের ওপর হামলা চালায়। তাদের একজন ধারালো কিছু দিয়ে পারভেজের পেট ও বুকের মাঝামাঝি কোপ দেয়। পরে রক্তাক্ত পারভেজকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিকমাধ্যমে। স্বভাবতই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে খুনের ঘটনাটি। সামাজিকমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। দাবি ওঠে, প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনার। এ ঘটনায় রোববার আটজনের নাম উল্লেখ করে বনানী থানায় মামলা করেন নিহতের মামাতো ভাই হুমায়ন কবির। এজাহারে অজ্ঞাতপরিচয়ে আরও ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়। এরই মধ্যে রোববার রাতে তিনজনকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন হলেন আল-কামাল শেখ, আলভি হোসেন জুনায়েদ ও আল-আমিন সানি।
এদিকে এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সরাসরি অভিযোগ তুলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীর দিকে। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। রোববার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম দাবি করেন, জাহিদুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ নেতাকে দায়ী করেন। এমনকি রাকিবুল দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বনানী থানায় গিয়েও বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে রাকিবুলের অভিযোগকে ‘ঘৃণ্য মিথ্যাচার’ বলে প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছাত্রদল বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
আমরা মনে করি, বনানীর মর্মান্তিক এ ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক, বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষাস্থলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় পাঠরত শিক্ষার্থীদের মনন যদি হীনতা কিংবা ক্ষুদ্রতার গণ্ডি পেরোতে না পারে; তা যদি বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গির স্বাদ ও সন্ধান না পায়—তা সত্যিই দুর্ভাগ্য ও হতাশার। আমরা জানি না, এ ঘটনার পেছনে আরও কোনো কারণ আছে কি না। তবে কারণ যা-ই থাকুক না কেন, কেউই আইন হাতে তুলে নেওয়ায় অধিকার রাখে না। এরই মধ্যে পুলিশের তৎপরতাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমাদের প্রত্যাশা, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনসহ দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
মন্তব্য করুন