পিরিয়ড বা মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি প্রাকৃতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও আমাদের সমাজে এখনো এটি ঘিরে রয়েছে নানা কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও সংকোচ। অনেক সময় মাসিককে কেবল নারীদের সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, অথচ মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নারী-পুরুষ উভয়েরই সচেতনতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবারে একজন বাবা, ভাই বা স্বামী যদি এ বিষয়ে সচেতন না হন, তবে নারীরা প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। যেমন, কিশোরীর প্রথম মাসিক শুরু হলে স্বাস্থ্যসামগ্রী কেনা বা স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাও পুরুষ অভিভাবকের দায়িত্ব। কর্মক্ষেত্রেও পুরুষ মালিক বা সহকর্মীদের সহানুভূতিশীল ভূমিকা না থাকলে নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।
নারীর পিরিয়ড, দায়িত্ব কি কেবল নারীর?
পিরিয়ড চলাকালে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নানা কষ্টের মধ্যেও সংসার, কর্মজীবন ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মাথাব্যথা, পেটব্যথা, দুর্বলতা, মুড সুইং—সবকিছুর মাঝেও তারা থেমে যান না। অথচ এখনো বহু পুরুষ পিরিয়ড সম্পর্কে খুব সামান্যই জানেন। কিশোর বয়স থেকেই বিষয়টি তাদের কাছে নিষিদ্ধ এক জ্ঞান হিসেবে উপস্থাপিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে আচরণে অসংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে।
ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার এতটাই আমাদের কুক্ষিগত করেছে যে, অনেক নারী রমজানে শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও রোজা না রেখে ‘মানুষ কী বলবে’ ভেবে সারা দিন উপোস থাকেন। শিক্ষাব্যবস্থায় পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা তৈরির কথা থাকলেও শিক্ষক ও অভিভাবকরা এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করেন। অনেক সময় পাঠ্যবইয়ের সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ছিঁড়ে ফেলা বা লুকিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মাসিককালীন স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে এখনো বহু নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। কুসংস্কার, অনীহা ও উচ্চমূল্যের কারণে তারা অপরিচ্ছন্ন বিকল্প ব্যবহার করেন, যার ফলে ইউরিনারি ইনফেকশন, জরায়ু সংক্রমণসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।
তথ্য স্পষ্ট, ঘাটতি সচেতনতায়
২০২৪ সালের আরেক গবেষণায় জানা যায়, কেবল ৩২ শতাংশ কিশোরী প্রথম মাসিকের আগে এ সম্পর্কে জানত। জরুরি স্যানিটারি প্যাড পাওয়ার সুযোগ রয়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ স্কুলছাত্রীর জন্য। ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্র্যান্ড ‘সেনোরা’ এবং ওজিএসবির যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাত্র ১৭.৪ শতাংশ নারী মাসিক চলাকালে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ৮৩ জন নারী এখনো স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত। স্কুলে গড়ে ৪০ শতাংশ ছাত্রী মাসিক চলাকালে তিন দিন অনুপস্থিত থাকে এবং পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রায় ৬০ লাখ নারী মাসিকের কারণে গড়ে ছয় দিন কাজে যেতে পারেন না। এ ছাড়া মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাবা এবং ১ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাই পরিবারের মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দেন।
২০২৫ সালে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ নারী মাসিক চলাকালে স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ব্যবহার করতে পারেন না। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে স্যানিটারি প্যাডের উচ্চমূল্য, সচেতনতার অভাব এবং কুসংস্কার। বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ১১,০০০-এর বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মারা যান। সময়মতো সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ২০৭০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
লজ্জা নয়, সচেতনতা শুরু হোক ঘর থেকেই
পিরিয়ড ঘিরে কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং সংকোচ দূর করতে হলে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে ঘর থেকে সমাজ পর্যন্ত। পরিবারের সদস্যদের জানা উচিত, মাসিককালীন অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার, দীর্ঘ সময় একই ন্যাপকিন ব্যবহার কিংবা অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের ফলে ইউরিন ইনফেকশন, জরায়ু সমস্যা এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
এ সময় স্বাস্থ্যবিধি ও পুষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। আয়রন, দুধ, ডিম, পানি ও তরল খাবার গ্রহণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও গোসল স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি। স্যানিটারি ন্যাপকিন ছয় ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। ন্যাপকিন পরিবর্তনের সময় যোনি অঞ্চল হালকা গরম পানিতে ধোয়া উচিত, তবে অতিরিক্ত সাবান বা রাসায়নিক ব্যবহার এড়িয়ে চলা ভালো। ব্যথা কমাতে গরম পানির সেঁক সহায়ক হলেও, পেইনকিলার গ্রহণে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সচেতনতা গড়ার জন্য পরিবার ও সমাজের পুরুষ সদস্যদেরও দায়িত্ব রয়েছে। ছেলে সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই মাসিক সম্পর্কে ইতিবাচক শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে সহানুভূতিশীল পুরুষ হয়ে উঠতে পারে।
নারী শরীরের ভাষা বোঝা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য জরুরি
নারী শরীরের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো—যেমন মাসিক, গর্ভধারণ ও মেনোপজ—সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা একজন নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলার মূলভিত্তি। এই জ্ঞান শুধু নিজের শরীর বোঝাতে সাহায্য করে না; বরং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পুষ্টি নির্বাচন, বিশ্রামের গুরুত্ব বোঝা এবং দৈনন্দিন জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক। মাসিক চক্রের সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামার ফলে অনেক নারী পিএমএস, তলপেট ব্যথা, মাথাব্যথা, বমিভাব বা মুড সুইংয়ের মতো শারীরিক-মানসিক অস্বস্তিতে ভোগেন।
এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে সচেতনতা শুধু নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরুষদের মধ্যেও থাকা প্রয়োজন। পুরুষরা যদি নারীর মাসিককালীন শারীরিক ও মানসিক অবস্থাগুলো সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে তারা আরও সহানুভূতিশীল ও সমর্থনশীল হয়ে উঠতে পারেন। পরিবারে স্বামী, ভাই, বাবা বা ছেলে যখন নারী সদস্যদের পাশে দাঁড়ান, তখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। পাশাপাশি সমাজে লিঙ্গ সমতা, সহানুভূতিশীলতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
মাসিক মানে সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব
মাসিক নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা শুধু নারীর একক দায়িত্ব নয়—এটি নারী-পুরুষ সবারই মানবিক দায়িত্ব। কারণ, এই প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়াটিই মানবজাতির টিকে থাকার ভিত্তি। একজন সুস্থ মা-ই পারেন একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে এবং একটি সচেতন ও শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তুলতে। মাসিককে লজ্জার বিষয় না ভেবে জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নারীরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক সমর্থন থেকে যেন বঞ্চিত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যখন পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাই মাসিক বিষয়ে সচেতন হবে, তখনই সম্ভব হবে একটি স্বাস্থ্যসম্মত, মর্যাদাপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা। মাসিক সচেতনতা তাই শুধু স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয় নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ন্যায়বিচারও।
লেখক: পরিবেশ ও নারী অধিকারকর্মী
মন্তব্য করুন