ড. সজল চৌধুরী
প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ মে ২০২৫, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের শহরের স্থাপত্যের মানদণ্ড কী

আমাদের শহরের স্থাপত্যের মানদণ্ড কী

আমাদের শহর প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। নতুন নতুন ভবন, রাস্তা, উড়ালসড়ক, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স আর আবাসিক ভবনের জোয়ার চলেছে চারপাশে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উন্নয়ন কি শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য, নাকি এর পেছনে কোনো মানদণ্ড বা নীতিমালা আছে? আমাদের শহরের স্থাপত্য কতটা মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য আর ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী—সেটাই ভাবার সময় এখন।

আমাদের শহরের স্থাপত্যের মানদণ্ড বোঝার জন্য কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ চোখে আনা যায়। ধরুন, পুরান ঢাকার অনেক পুরোনো বাড়িগুলোতে ছোট ছোট খোলা উঠান আছে, যেখানে পরিবারের সদস্যরা বসে গল্প করেন, শিশুরা খেলে, বাতাস চলাচল করে—এ জায়গাগুলো সামাজিক সম্পর্ক আর প্রাকৃতিক স্বাচ্ছন্দ্যের দিক থেকে দারুণ পরিকল্পিত। আবার উত্তরার কিছু আবাসিক এলাকায় দেখা যায়, সড়ক প্রশস্ত, হেঁটে চলার পথ রয়েছে, গাছগাছালিতে ছায়া পাওয়া যায়; যা পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে, অনেক আধুনিক আবাসিক প্রকল্পে দেখা যায়, ভবনগুলো খুব ঘনভাবে গাঁথা, জানালা থেকেও আলো-বাতাস ঠিকমতো আসে না। কাচে মোড়া বাণিজ্যিক ভবনগুলো প্রচণ্ড গরম তৈরি করে, ভেতরে সারাক্ষণ এসি চালাতে হয়, ফলে বিদ্যুৎ খরচ বাড়ে। একটি ইতিবাচক উদাহরণ হতে পারে গ্রিন বিল্ডিং ধারণা, যেমন গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানা—যেখানে ছাদে বাগান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করে কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব উদাহরণ দেখায়, স্থাপত্য শুধু বিল্ডিং বানানো নয়, মানুষের জীবন, আবহাওয়া ও সমাজের সঙ্গে মানানসইভাবে একে গড়ে তোলাই আমাদের শহরের স্থাপত্যের আসল মানদণ্ড।

স্থাপত্য মানে শুধু একটা দালান বানানো নয়। এটা মানুষের জীবনধারার সঙ্গে, আবহাওয়ার সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা ভবন কেমন হবে, তার জানালা কোন দিকে মুখ করে থাকবে, সেখানে আলো-বাতাস কেমন আসবে, কত মানুষ সেখানে থাকবে, তাদের চলাফেরা কেমন হবে—এসবই স্থাপত্যের অংশ। তাই যখন আমরা শহরের স্থাপত্যের মানদণ্ডের কথা বলি, তখন এসব দিকগুলো গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। এখানে বছরের অনেকটা সময় গরম আর আর্দ্রতা থাকে বেশি। কিন্তু শহরের অধিকাংশ দালান যেন এ জলবায়ুকে ভুলে গিয়ে বানানো হয়েছে। বড় বড় কাচের জানালা, সিলিংহীন ডিজাইন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরতা—এসব যেন আধুনিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অথচ এসব ডিজাইন আমাদের পরিবেশকে আরও বেশি উষ্ণ করে তুলছে, বিদ্যুৎ খরচ বাড়ছে আর মানুষের শারীরিক আর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমাদের শহরের আরেকটি বড় সমস্যা হলো জনঘনত্ব। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা—সব বড় শহরেই মানুষ গাদাগাদি করে বাস করছে। এ অবস্থায় ভবনের ডিজাইন হওয়া উচিত ছিল এমন ভাবে, যাতে মানুষ একটু খোলা জায়গা পায়, শিশুদের খেলার মাঠ থাকে, বৃদ্ধদের হেঁটে বেড়ানোর জায়গা থাকে আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ থাকে। কিন্তু বাস্তবে আমরা যা দেখছি তা হলো—একের পর এক উঁচু দালান, যেখানে শুধু ফ্ল্যাট আর পার্কিং স্পেস আছে, মন ও শরীরের জন্য নেই কোনো মুক্তির পরিসর।

স্থাপত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি। একটা ভবন বা শহরের নকশা কেমন হবে তা যেন শুধু ধনী বা ক্ষমতাবানদের সুবিধা বিবেচনা করে না হয়। সবাই যেন সমানভাবে উপকৃত হয়, এ নীতিই হওয়া উচিত আমাদের স্থাপত্যের মানদণ্ড। বিশেষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের, শিশুদের, নারীদের এবং প্রবীণদের সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো ডিজাইনের শুরুতেই ভাবা উচিত। স্থাপত্য শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের কথাও বলে। আজ যে ভবন বানানো হচ্ছে, সেটা পরবর্তী বিশ বা ত্রিশ বছর ব্যবহার করা হবে। তাই এ ভবন কতটা টেকসই, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা সহনশীল আর পরিবেশের ওপর এর প্রভাব কতটুকু—এসব হিসাব এখনই করতে হবে। পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, প্রাকৃতিক আলো-বাতাস এর সঠিক ব্যবহার, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও ব্যবহারের উপায়, সৌরবিদ্যুৎ—এসবই হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ স্থাপত্যের মানদণ্ড।

কিন্তু প্রশ্ন থাকে, এসব মানদণ্ড কে ঠিক করবে? সরকার, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নাকি নাগরিক? আসলে সবারই দায়িত্ব আছে। সরকারকে কঠোরভাবে ভবন অনুমোদনের আগে পরিবেশ, সমাজ ও ব্যবহারের দিক বিবেচনা করতে হবে। স্থপতিদের দায়িত্ব হলো শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, বরং মানুষের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন আর সুস্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইন করা। আর আমাদের, সাধারণ নাগরিকদেরও জানতে হবে আমরা কেমন পরিবেশে থাকতে চাই, কীভাবে আমাদের শহর আরও মানবিক আর বাসযোগ্য হতে পারে। শহরের স্থাপত্য যদি মানুষের অভিজ্ঞতা ও চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তা শুধু কংক্রিটের জঙ্গলেই পরিণত হবে। তাই আমাদের শহরের স্থাপত্যের মানদণ্ড হওয়া উচিত পরিবেশবান্ধব, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার গুরুত্ব দেয় এমন।

শহর আমাদের সবার। তাই শহরের স্থাপত্য কেমন হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবর্তন আনতে হলে প্রশ্ন করতে হবে, ভাবতে হবে আর একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে একটি টেকসই, মানবিক ও সুন্দর শহর—আমাদের সবার জন্য।

লেখক: স্থপতি, শিক্ষাবিদ এবং চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমিরাতের বিপক্ষে হারে শিশিরকে দায়ী করলেন লিটন

ফাঁস দিলেন স্ত্রী, শ্বশুরবাড়িতে জানিয়েই পালালেন স্বামী 

পুরো গাজাই নিয়ে নেবেন নেতানিয়াহু!

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতপন্থিদের তীব্র সংঘর্ষ, নিহত ১২

কবরস্থানের গাছ বিক্রির অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে 

​​​​​​​ট্রাম্প যুদ্ধ থামিয়েছেন, অস্বীকার করছে ভারত

গায়ক নোবেল গ্রেপ্তার

আন্দোলনকারীদের নতুন নির্দেশনা দিলেন ইশরাক

রাতে স্ত্রীকে খুন, ভোরে আত্মসমর্পণ করলেন স্বামী

জামিন পেলেন নুসরাত ফারিয়া

১০

উড্ডয়নের পরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

১১

ধাক্কাধাক্কির জেরে কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা

১২

পাকিস্তানকে সমর্থন করায় মুসলিম দেশের পণ্য বয়কট ভারতের

১৩

আইসিইউ থাকলেও চিকিৎসক নেই ৩ বছর

১৪

স্টারলিংকে খরচ কত পড়বে?

১৫

পর্যটকশূন্য টেংরাগিরি ইকোপার্ক, নেপথ্যে কী এই সেতু?

১৬

ফ্রিতে হজের আমন্ত্রণ জানাল সৌদি আরব

১৭

দেশে যাত্রা শুরু করেছে স্টারলিংক

১৮

ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তি-সংস্থার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা

১৯

ক্যানসার আক্রান্ত বাইডেন আছেন আর মাত্র দুই মাস!

২০
X