খায়রুল আনোয়ার
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুন ২০২৫, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতিতে ঢাক ঢাক গুড় গুড়

রাজনীতিতে ঢাক ঢাক গুড় গুড়

দেশ এক কঠিন সময় পার করছে। প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে চলেছে। নানা গুঞ্জন-জল্পনা ডালপালা মেলছে। সন্ধ্যার পর উপদেষ্টাপাড়ায় কোনো কোনো উপদেষ্টার বাসভবনে গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফুসুর চলে। গোপন বিষয়টি আর গোপন নেই। এ নিয়ে টিভি টকশো ও সামাজিকমাধ্যমে এখন ব্যাপক আলোচনা চলছে। গত ২১ মে থেকে চার দিন ঘটনাবহুল সময় অতিবাহিত হয়। বিরাজ করে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। স্বৈরাচারী লীগ সরকারের পতনের পর চার দিন সরকারবিহীন দেশেও এ পরিস্থিতি ছিল না। সেনাপ্রধানের বক্তব্য, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক, কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সরকারের বিবৃতি পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান বিচারপতি। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি এভাবে সাক্ষাৎ করতে পারেন কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংস্কারকে যেমন নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে, তেমনি সেনাবাহিনীকেও প্রতিপক্ষ করার চেষ্টা চলছে। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে সশস্ত্র বাহিনী কোনো আপস করবে না। তবে সরকারের পরিপূরক হিসেবে সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে বলে বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে ধোঁয়াশা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অর্থনীতির নাজুক অবস্থা দেশকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সরকার বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে পারছে না অথবা করতে চাইছে না। হয়তো উটপাখির মতো মুখ গুঁজে চলার নীতি নিয়ে চলছে। সামনের দিনগুলো সংঘাতময় হওয়ার শঙ্কা রয়েছে জনমনে। সবার একই প্রশ্ন, কেন এমন হচ্ছে, সামনের দিনে কী হতে যাচ্ছে?

নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কার ও গণহত্যার বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রীতিমতো বাহাস চলছে, যা কখনো কখনো রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তারুণ্যের সমাবেশে সাফ জানিয়ে দেন, ‘নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা চলবে না, নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে হবে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পদে পদে।’ চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে ফিরে তিনি এই প্রথম দলীয় সমাবেশে বক্তব্য দেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ২৯ মে জাপানের টোকিওতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে একটি দল।’ তিনি যে একটি দল বলতে বিএনপিকে ইঙ্গিত করেছেন, তা স্পষ্ট। প্রফেসর ইউনূস যে কোনো পরিস্থিতিতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তার বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করেন। এর আগে ২১ মে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘অফিসার্স অ্যাড্রেসে’ নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হওয়া উচিত বলে মতপ্রকাশ করেন। নির্বাচনের সময়সীমা এক গোলকধাঁধার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী সংস্কার এবং নির্বাচনের জন্য দুটি পৃথক রোডম্যাপ চায়। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াত অনেকবার তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। দলটি এখন বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে নির্বাচন হতে পারে। সংস্কারের জন্য আরেকটু সময় লাগলে রোজার পর নির্বাচন হতে পারে। তবে এর চেয়ে বিলম্ব হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। আবহাওয়া অনুকূল থাকবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনের সময়সীমার চাইতে সংস্কার এবং জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এনসিপির কোনো কোনো নেতা নির্বাচনের আগে গণহত্যার বিচার শেষ করার দাবি জানাচ্ছেন। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ডিসেম্বর থেকে জুন—একেবারেই অস্পষ্ট একটি রোডম্যাপ। আগামী রোজার পর দুটি পাবলিক পরীক্ষা, কোরবানির ঈদ, ঝড়-বৃষ্টি নির্বাচনের জন্য মোটেই অনুকূল সময় নয়। এ দেশে জুন মাসের নির্বাচন হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা প্রলম্বিত করার জন্য রোডম্যাপ নিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। পাঁচ থেকে ছয়জন উপদেষ্টার দিকে দলটির সন্দেহের তীর।

৮ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ১০ মাস পূর্ণ হবে। সরকার আইনশৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা তো দূরের বিষয়, বরং মাঝেমধ্যেই পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি ছুড়ে, ছুরি মেরে ৩৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ২৭ মে। ১৪ মে মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ এলাকায় একটি বাসায় ডাকাতি করতে গিয়ে বাধা পেয়ে এক পরিবারের সাতজনকে কুপিয়ে জখম করে কিশোর গ্যাং। ১৮ মে সেন্ট্রাল রোডে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৫ মে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছুদিন আগে মহাসড়কে বাসে ডাকাতি ও নারীর শ্লীলতাহানি ঘটনা ঘটেছে। কবে নাগাদ জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরে আসবে, সাধারণ মানুষ ভয়-আতঙ্ক ছাড়া চলাফেরা করতে পারবে—তার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতির পাশাপাশি অর্থনীতির নাজুক অবস্থার কথা ফুটে উঠেছে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের কথায়। প্রধান উপদেষ্টার আস্থাভাজন ড. দেবপ্রিয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনায় মুখর। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ২৭ লাখ মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ লাখ নারী। দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে; কিন্তু বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেই।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘নতুন সরকার কি বৈষম্যবিরোধী শেখাচ্ছেন?’ অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে ড. দেবপ্রিয় মন্তব্য করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রফেসর ইউনূস পতিত সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে। গবেষণা সংস্থা সিপিডির মতে, অর্থনীতির প্রয়োজনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জরুরি। ২৭ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পার হওয়ার পর এখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সময় এসেছে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি বা মার্চ যে মাসেই হোক, সরকারের সুস্পষ্ট করা উচিত। সিপিডির বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় দেশের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংস্থান এবং প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থবছরের প্রায় শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতি এক জটিল সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে।

সংস্কার কার্যক্রমেও কোনো আশাব্যঞ্জক খবর নেই। মৌলিক সংস্কার নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, নির্বাচন পদ্ধতি, সংখ্যানুপাতিক উচ্চকক্ষ, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, সংবিধান সংশোধনে গণভোট, সংস্কার বাস্তবায়ন পদ্ধতিসহ আরও অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো একমত হতে পারেনি। কীভাবে সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়েও দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত। সংস্কারের প্রস্তাবনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের সংলাপে যেসব মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ ঈদের ছুটির আগেই শুরু হবে। প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি কমিশনের ১৬৬ সুপারিশের বিষয়ে মতামত নিয়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক করেছে কমিশন। প্রশ্ন হচ্ছে, কবে নাগাদ রাজনৈতিক দলগুলো মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে? আদৌ দলগুলো এ নিয়ে একমত হতে পারবে কি না, সে প্রশ্নও থেকে যায়। কেননা, স্বৈরশাসনের পতনের ইস্যুতে জুলাইয়ের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে। নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে মতবিরোধ প্রবল হয়ে উঠেছে। ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত, এ কথা অনেক আগেই কমিশন জানিয়েছে। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। অথচ এই কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের সার্চ কমিটির মাধ্যমেই গঠিত হয়েছে। কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি নিয়েও চলছে পাল্টাপাল্টি। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি উঠছে। ‘নির্বাচনের আগে সংস্কার’ এ বিষয়ে বেশি বেশি কথা বলা উপদেষ্টারা ১০ মাসে তাদের মন্ত্রণালয়ে কী কী সংস্কার করেছেন, এ প্রশ্নও আছে। অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের আশঙ্কা সব মিলিয়ে রাজনীতির আগামী দিনের চিত্র ধূসর বলেই মনে হয়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টিকটকে পরিচয়, ইয়াসিনের বাড়িতে উঠলেন এক সন্তানের জননী

ইরানের সামরিক স্থাপনায় ইসরায়েলের ‘হামলা’

জুলাইয়ে ঘটতে পারে মহা বিপর্যয় : বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী

রাডার ফাঁকি দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান

‘বিএনপি চায় উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক’

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বুধবার অংশ নেবে জামায়াত

ইসরায়েলের ২৮টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি ইরানের

কথিত সেই যুবদল নেতা ফের চাঁদাবাজি করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক

খুলনায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ছাত্রদল নেতাসহ গ্রেপ্তার ৫

ইসরায়েলে এবার ‘শাস্তিমূলক’ অভিযানের ঘোষণা

১০

বিএনপি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় : সালাহউদ্দিন

১১

ফুরিয়ে আসছে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার

১২

জনতার হাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আটক

১৩

নির্বাচনে বিএনপির অবশ্যম্ভাবী বিজয়ে অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই : প্রিন্স

১৪

খামেনির অবস্থান শনাক্ত ও ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি ট্রাম্পের

১৫

পাহাড়ের নিচে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র, ধ্বংস করতে পারবে না ইসরায়েল

১৬

লা লিগার চাপে বার্সা, থমকে ট্রান্সফার পরিকল্পনা

১৭

ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তার বাসায় ইসরায়েলের হামলা

১৮

শতভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করছে না ঐকমত্য কমিশন : এনসিপি

১৯

ভালুকায় সরকারি হাসপাতালে দুদকের অভিযান

২০
X