দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ইহুদিরা। অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে ইউরোপের প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি প্রাণ হারিয়েছিল। এটি ছিল তৎকালে ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিদের মোট সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এই ৬০ লাখের মধ্যে ১৫ লাখই ছিল শিশু। প্রায় চার বছর ধরে চলা নির্মম এ হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে পরিচিত। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় থাকা বন্দিদের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়। খাবার-দাবার কখনোই ঠিকমতো জুটত না তাদের ভাগ্যে। ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরেই রাতদিন খাটতে হতো তাদের। এর ফলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত এ মানুষগুলো হয়ে পড়েছিল বেশ দুর্বল, তাদের চামড়াও হয়ে গিয়েছিল ধূসর বর্ণের। দূর থেকে দেখলে মনে হতো কোনো জীবন্ত কঙ্কাল বুঝি হেঁটে বেড়াচ্ছে। হলোকাস্টের শুরুর দিকে নাৎসি বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের বন্দি করা। ধরা পড়ার ভয়ে অনেকেই এ জন্য তাদের জন্মসনদ পুড়িয়ে ফেলেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করেও নাৎসি বাহিনীর কবল থেকে রেহাই পায়নি ইহুদিরা। ফলে তারা জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় জর্ডান নদীর তীরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সাত দশকের বেশি সময় ধরে নিরীহ, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ইসরায়েলকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিসংঘ। শিশু হত্যা, পঙ্গুত্ব, স্কুল ও হাসপাতালের ওপর হামলা এবং শিশুদের সশস্ত্র সংঘাতে নিয়োগের মতো গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ থাকার ভিত্তিতেই তাদের এ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত জাতিসংঘের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে মোট সহিংসতার প্রায় ২০ শতাংশের জন্যই দায়ী ইসরায়েল। ‘চিলড্রেন ইন আর্মড কনফ্লিক্ট’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্বব্যাপী শিশুদের ওপর গুরুতর সহিংসতা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদন তৈরির জন্য জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিরুদ্ধে ৪১ হাজার ৩৭০টি গুরুতর সহিংসতার তথ্য যাচাই করে। এসব ঘটনার মধ্যে শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও ইসরায়েলে ২ হাজার ৯৫৯ শিশুর ওপর ৮ হাজার ৫৫৪টি গুরুতর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৯৪৪টি ফিলিস্তিনি শিশু ও ১৫টি ইসরায়েলি শিশু। জাতিসংঘ নিশ্চিত করেছে, গাজায় ১ হাজার ২৫৯ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত ও ৯৪১ শিশু আহত হয়েছে। তবে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনে নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি তারা ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং একটি ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যসহ বৃহত্তর অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এক উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক বৈঠক। আমরা মনে করি, আলোচনার পরিবেশ যত শান্তিপূর্ণই থাকুন না কেন, পরস্পরের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য ও অবিশ্বাস দূর করা প্রয়োজন। এটা করা না গেলে বিদ্যমান সংকটের সমাধান হবে না; বরং আরও জটিল হবে।
মন্তব্য করুন