মো. খালিদুল হক হাওলাদার
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ০৯:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিধবাদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর হোক

সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস বিশ্বব্যাপী বিধবাদের প্রতি বৈষম্য ও অবিচারের বিষয়টি তুলে ধরা এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জাতিসংঘের একটি কর্মদিবস। বিশ্বজুড়ে বিধবাদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জ এবং অবিচার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২৩ জুন আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস পালন করা হয়। এর মধ্যে অর্থনৈতিক কষ্ট, সামাজিক কলঙ্ক, বৈষম্য ও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উত্তরাধিকারের অধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

নিউইয়র্ক, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের ৬৫তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে, গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলি বোঙ্গো ওন্ডিম্বা বিশ্বব্যাপী বিধবাদের জরুরি দুর্দশার বিষয়ে পরিষদে ভাষণ দেন। তিনি বর্ণনা করেন যে কীভাবে লাখ লাখ বিধবা, শুধু তাদের স্বামী হারানোর কারণে, সমাজচ্যুত, জীবিকা হারানো ও গভীর দারিদ্র্যের মুখোমুখি হন, যার ফলে তারা এবং তাদের সন্তানরা দারিদ্র্য ও অসম্মানের মধ্যে পড়েন। এ ব্যাপক অথচ প্রায়ই অদৃশ্য বৈষম্য শুধু মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না বরং সম্প্রদায়ের সামাজিক কাঠামোকেও হুমকির মুখে ফেলে। প্রেসিডেন্ট ওন্ডিম্বা জোর দিয়ে বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য নারীদের, বিশেষ করে বিধবাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। তিনি জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিধবাদের সংগ্রামের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ‘আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস’কে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘের অনুমোদনক্রমে প্রতি বছর দিনটি উদযাপিত হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক বিধবা দিবসটি ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত হয় এবং লর্ড লুম্বা এবং ফাউন্ডেশনের সভাপতি চেরি ব্লেয়ার এটি চালু করেন। ২০১০ সালে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক বিধবা দিবসের মাধ্যমে রুয়ান্ডা, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেপাল, সিরিয়া, কেনিয়া, ভারত, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হয়। অনেক দেশে লাখ লাখ বিধবা এবং তাদের নির্ভরশীলদের দ্বারা সম্মুখীন দারিদ্র্য ও অবিচার মোকাবিলা করার জন্য দিনটি পালন করা হয়।

বিধাবাত্বের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দ্য লুম্বা ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। ২৩ জুনের তাৎপর্য হলো যে, ১৯৫৪ সালের সে দিনেই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড লুম্বার মা শ্রীমতি পুষ্প ওয়াতি লুম্বা বিধবা হয়েছিলেন। পেছনে ফেরা যাক। ভারতের পাঞ্জাবের ধিলওয়ানে, যখন একজন ধনী ব্যবসায়ী জাগিরি লাল লুম্বা ২৩ জুন ১৯৫৪ সালে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। তার মৃত্যু তার স্ত্রী পুষ্পা ওয়াতি এবং তাদের সাত সন্তানকে মানসিক ও সামাজিকভাবে ভেঙে ফেলে। সামাজিক কুসংস্কার ও রীতিনীতি চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের পরিবারের ওপর। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের দশ বছর বয়সী ছেলে রাজ লুম্বার জন্য। তার দাদি তার মাকে বিয়ের সব চিহ্ন চুড়ি, গহনা, বিন্দি ত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং শুধু সাদা পোশাকই ছিল তার পরিধেয় বস্ত্র। রাজ লুম্বার মা শ্রীমতি পুষ্প ওয়াতি লুম্বাকে ধীরে ধীরে অনুধাবন করানো হয় যে, তিনি বিধবা। এমনকি, কয়েক বছর পর বিধবা পুষ্প ওয়াতিকে দ্বিতীয় বিবাহের আসর থেকে বিয়ে না করে উঠে যেতে হয় এক পুরোহিতের আদেশের কারণে এই ভয়ে যে, তার ভাগ্য খারাপ হবে; যা রাজ লুম্বার মনে মারাত্মক আঘাত হানে। পরবর্তীকালে শক্তিশালী নারী পুষ্প ওয়াতি তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সন্তানদের উচ্চশিক্ষা এবং জীবনে সব বাধা অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠা লাভের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। যে মা সন্তানকে জন্ম ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং সর্বদা তার মঙ্গল কামনা করেছেন, তাকে কীভাবে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে দেখা যেতে পারে—এ বিশ্বাস সন্তান রাজ লুম্বাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে তিনি পরে যুক্তরাজ্য এবং ভারতে একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। জীবনে অর্থ ও খ্যাতি উভয়ই পেলেও তিনি কিন্তু শৈশবের দেখা বিধবাদের প্রতি অন্যায় ও সামাজিক রীতিনীতির কলঙ্ক কখনো ভোলেননি। বিশ্বব্যাপী সব বিধবা মা এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল সন্তানদের প্রতি নেমে আসা অদৃশ্য দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ২০০৫ সালে লর্ড লুম্বা ফাউন্ডেশন চালু করেন। সামাজিক বৈষম্যই ছিল প্রাচীন ভারতীয় সমাজে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারীদের জীবনে যন্ত্রণার প্রধান কারণ। সেই সময় বিধবাদের জন্য অলিখিত নিয়মে বলা ছিল, বিধবারা সামাজিক বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা তো স্বপ্নের মধ্যেও আনা বারণ ছিল। সেই সময় বেশিরভাগ হিন্দু বিধবার পরিবারগুলো তাদের কাশী, বৃন্দাবন অথবা মথুরাতে পাঠিয়ে দিত। আর সেখানকার জীবন ছিল আরও ভয়ংকর। তবে ঐতিহাসিকদের অনেকের মতে, ষোলো শতকে চৈতন্য মহাপ্রভু সতীদাহ থেকে বাঁচাতে বিধবা নারীদের একটি দলকে এই স্থানে নিয়ে এসেছিলেন। আর এরপর থেকে অনেক বিধবাই বাড়িতে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে এখানে পালিয়ে আসে। ক্রমে ক্রমে এ বিধবারাই বাতিলের দলে নাম লেখায়। আগেকার দিনে বাল্যবিয়ে ছিল একটি সামাজিক প্রথা। তার আগেও ছিল সতীদাহ প্রথা। এ প্রথা অনুযায়ী সহমরণে যেতে হতো বিধবাদের। স্বামীর জ্বলন্ত চিতার ওপর উল্লাস করতে করতে সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষরা বিধবাদের জ্যান্ত অবস্থায় সেই চিতায় উঠিয়ে দিত। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সেই ঘৃণ্য প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। সতীদাহ প্রথা রদ করার পর সমাজে বাল্যবিধবার সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সে সময় বিধবাদের পুনরায় বিয়ে করা ছিল সম্পূর্ণ সমাজবিরুদ্ধ ব্যাপার। সেই বিরোধিতা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের বিল পাস করেছিলেন। কিন্তু তবুও সে সময় বিধবারা চরম কষ্টে তাদের দিন যাপন করত। সেই সময় স্বামীর মৃত্যুর পর কম বয়সে বিধবাদের বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। স্বামীর গৃহে তাদের স্থান হতো না। সিঁথির সিঁদুর মুছে, সাদা থান পরে, গায়ের সব গহনা খুলে, চুল কেটে, একবেলা কোনোরকম নিরামিষ খাবার খেয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাত সেই সময়ের বিধবারা। বিশ্বজুড়ে ২৫৮ মিলিয়ন বিধবা রয়েছে আর তাদের ১০ জনের মধ্যে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় বিধবার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার কারণস্বরূপ দেখানো হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বে ১০ জন বিবাহযোগ্য বয়সী নারীর একজন বিধবা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশে ক্রমাগত বিধবা নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপ ২০১৯-এ বলছে, বয়সী নারীরাই বিধবা হচ্ছেন বেশি। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের অনুসারে, দেশে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৭ লাখ। বিবিএসের ‘দ্য রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৯’ শীর্ষক এ জরিপ বলছে, এ নারীদের ৬৩ দশমিক ৮ ভাগ বিবাহিত।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশে বিধবা নারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার জন্য সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়। এর মধ্যে প্রধান হলো বিধবা ভাতা, যা মাসিক ভিত্তিতে প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিধবাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা কার্যক্রমও বিদ্যমান। যেমন বিধবা ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, আবাসন ও পুনর্বাসন এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি। তবে এসব সামাজিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানারকম প্রতিবন্ধকতা। এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্য, আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করা, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসের তালিকা সহজলভ্য করা প্রয়োজন।

লেখক: অধিনায়ক, র‌্যাব-২

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স / রোগীদের নিম্নমানের খাবার দেওয়ার অভিযোগ

কলম্বোতে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, একাদশে ফিরেছেন মিরাজ

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে হাওরে হাউসবোট দখলের অভিযোগ 

বৃহস্পতিবার শুরু এইচএসসি, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

অতর্কিত হামলায় ইসরায়েলের ৭ সেনা নিহত

দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন ওএসডি

লাল ডিম না সাদা ডিম, কোনটির পুষ্টিগুণ বেশি

ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে দুটি সংবাদমাধ্যম, ট্রাম্পের ক্ষোভ

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন / বাঙ্কার বাস্টারেও ধ্বংস হয়নি ইরানের পরমাণু কেন্দ্র

ইরানে ফের হামলার চেষ্টা, ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত

১০

রাজশাহী মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠনে সতর্ক চিঠি

১১

ভুল রক্ত পুশ করায় মৃত্যুর মুখে রোগী, পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও

১২

একযোগে ৩৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা

১৩

চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা 

১৪

খামেনির বিপদ কাটেনি, সামাল দিতে হবে নিজ জাতির ক্ষোভ

১৫

ইরানে যুদ্ধের অবসান : তেহরানের বর্তমান পরিস্থিতি

১৬

মাঝ নদীতে ভাসছিল ৪০ যাত্রীসহ ট্রলার, এরপর যা ঘটল

১৭

বিএনপিতে দখলবাজ নেতাকর্মীর স্থান নেই : মিফতাহ্ সিদ্দিকী

১৮

সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম

১৯

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

২০
X