গত বছরের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর সহজ পথে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একান্ত বৈঠকের পর নির্বাচনী আকাশের মেঘ অনেকটাই কেটে গেছে—এমনটি ধারণা করছেন অনেকে। তবে কেউ কেউ এখনো সন্দিহান, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। আর এ সন্দেহ উদ্রেকের কারণ রাষ্ট্রীয় ও নির্বাচনসংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ঐকতানের অনুপস্থিতি। লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি যে অবস্থান নিয়েছে, তা জাতীয় নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। জামায়াতে ইসলামী লন্ডন বৈঠক নিয়ে শুধু অসন্তোষ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, এর প্রতিবাদে তারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তিন দিনের বৈঠকের প্রথম দুদিন অনুপস্থিত থেকেছে। জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জামায়াতের এই নেতিবাচক অবস্থান সচেতন ব্যক্তিরা শুধু অনভিপ্রেতই নয়, অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে সদ্যভূমিষ্ঠ রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপি অভিযোগ করেছে, লন্ডন বৈঠকের ফলে তারা বুঝতে পেরেছে, সরকার বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এনসিপির অভিযোগ মতে, সরকার যদি বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দেয়ও, তা কি খুব একটা অন্যায় হয়েছে? বিএনপি বিপুল জনসমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দলটি এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আগামী দিনে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে এই দলটি যে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে তাতে সন্দেহ নেই। তাই বলে এটা নয় যে, শুধু তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড. ইউনূস ইচ্ছে করলে দেশে অবস্থানরত অপরাপর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে যৌথ বিবৃত দিতে পারেন। তাতে বিএনপির কোনো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। এনসিপি বলেছে, সরকার বিএনপির দিকে ঝুঁকে গেছে, তাদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অন্তর্বর্তী সরকার এনসিপিকেই তাদের প্রাপ্যতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। রাষ্ট্র সংস্কার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোরই বৈঠক হওয়ার কথা। অথচ প্রতিটি বৈঠকে বিএনপি-জামায়াতের পরই গুরুত্ব পেয়ে আসছে নবজাতক সংগঠন এনসিপি (দুষ্টলোকেরা বলে ‘নিওনেটাল চিলড্রেন পার্টি’, বাংলায় ‘নবজাতক শিশু দল’)। এমনকি মাঝখানে বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ড. ইউনূস পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এনসিপির নেতাদের কাছেই। এসব কারণে সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার অনিবন্ধিত সংগঠন এনসিপিকে রাজনৈতিক দলের মর্যাদা দিয়ে বৈষম্যের অনুশীলন করছে; যা শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক বায়ুপ্রবাহে ‘ঘূর্ণিবাত’ সৃষ্টি করতে পারে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক শেষ হয়েছে গত ১৯ জুন। অচিরেই হয়তো তৃতীয় পর্যায়সহ আরও বৈঠক হবে। তবে সেসব বৈঠকে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে জামায়াত-এনসিপির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কথা উঠেছে ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও। জামায়াত-এনসিপিসহ সমমনা দলগুলো দ্রুত জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। তারা এও বলছে, জুলাই সনদ ঘোষণার আগে নির্বাচনের পথে হাঁটা যাবে না। এ বিষয়ে গত ১৭ জুন দৈনিক কালবেলার ‘জুলাই সনদে কে কী চায়’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহুল আলোচিত জুলাই সনদ নিয়ে রাজনীতিতে নানামুখী সমীকরণ হচ্ছে। বিএনপি জুলাই সনদের ব্যাপারে আপত্তি না করলেও বিষয়বস্তু দেখে তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য কয়েকটি দল বলছে, জুলাই সনদের আলোকেই আগামী সংসদ নির্বাচন হতে হবে। এনসিপি বলছে, তারা চায় না জুলাই সনদ নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার পরিণতি গ্রহণ করুক। অর্থাৎ তারা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়।
এদিকে গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জুলাইয়ের মধ্যেই জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। কালবেলা লিখেছে, সরকার মনে করছে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পথে বাধা বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র চায় না তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে রাজি করাতে সরকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। আমরা তাদের কো-অপারেট করছি। ছাত্ররা তাদের বয়ান দিয়েছে। আলোচনা করে আমরা আমাদের ড্রাফট গত ১২ ফেব্রুয়ারি দিয়েছি। বল এখন সরকারের কোর্টে। এখন সমন্বয় করার দায়িত্ব সরকারের। আমরা যদি মনে করি সেটা (জুলাই ঘোষণাপত্র) যথোপযুক্ত হয়নি, তাহলে আমরা ওইটার সঙ্গে কতটুকু সংশ্লিষ্ট থাকব সেটা তখন দেখা যাবে। তিনি বলেছেন, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল, এর সাংবিধানিক ভিত্তি ও গুরুত্ব নেই।’ অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘অবশ্যই নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ হওয়া উচিত। তবে সেখানে কী কী জিনিস অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেটিই মূল বিষয়। তিনি মন্তব্য করেন, জুলাই সনদে অবশ্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, সরকারের মৌলিক চরিত্র কী হবে, নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে ইত্যাদি বিষয় রেখেই জুলাই সনদ হতে হবে। অন্যদিকে জামায়াতের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু মনে করেন, জুলাই সনদ হওয়া উচিত শুধু নয়, এটা একান্ত আবশ্যক। এ সনদটা হবে জুলাই অভ্যুত্থানের একটা অঙ্গীকার। বিএনপি যদি সহযোগিতা করে, তাহলে এ সনদ তৈরি সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র অবশ্যই দিতে হবে। অন্যথায় সেটি জনগণ মেনে নেবে না। জুলাইয়ের কোনো আইনি স্বীকৃতি এবং মৌলিক সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনের পক্ষে নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে গত ১৮ জুন ইনকিলাব মঞ্চ নামের একটি সংগঠন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, জুলাই-গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার না করে যদি নির্বাচন করা হয়, তাহলে তারা ড. ইউনূসকে শ্রেষ্ঠ ‘গাদ্দার’ ঘোষণা করবে।
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির উদ্দেশ্য হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সহৃদয় পাঠকদের ধারণা দেওয়া। সরকার ও এনসিপির কথায় মনে হওয়া স্বাভাবিক বিএনপি জুলাই সনদের বিরোধিতা করছে। বস্তুত সেটা নয়। বরং বিএনপি যেটা বলেছে, সেটা অবশ্যই যৌক্তিক। কেননা, সনদে কী থাকছে না থাকছে, তা নিশ্চিত না হয়ে বিএনপির মতো একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল অন্ধ সমর্থন (ব্লাইন্ড সাপোর্ট) দিতে পারে না। গত বছরের আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজনের চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে আমাদের গৌরবময় অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যার অংশ হিসেবে কেউ কেউ আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। আবার কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে হেয়প্রতিপন্ন করারও অপপ্রয়াসে নানারকম কল্পকাহিনি ছড়াচ্ছে। এরা একাত্তরের মহান শহীদদের সঙ্গে ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের সময় বিভিন্ন দাঙ্গায় নিহতদের এক কাতারে দাঁড় করানোর হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে ওইসব অপচেষ্টাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে গৌরবময় ভূমিকা নিয়ে জড়িয়ে আছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান; যিনি একাত্তরের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সচেতন ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, জামায়াত ও তাদের সুহৃদ সংগঠনগুলো জুলাই অভ্যুত্থানকে পুঁজি করে এমনভাবে একটি ঘোষণাপত্র ও সনদ তৈরি করতে চাচ্ছে, যেখানে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস অবমাননার শিকার হতে পারে। একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এ প্রক্রিয়ার অংশীজন হতে পারে না সংগত কারণেই।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক দলিল হতে পারে, কোনোভাবেই এর কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি থাকবে না। তার এ বক্তব্যে জামায়াত ও তাদের অনুগামী-অনুসারীরা নাখোশ হবে সন্দেহ নেই। কেননা, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পুঁজি করে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকে ক্ষুণ্ন করার যে পরিকল্পনা এঁটেছে, বিএনপির অনমনীয় অবস্থান সে পথে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে। আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, খোদ অন্তর্বর্তী সরকারও মনে করছে, জুলাই সনদ ঘোষণার পথে বিএনপি অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
এমন পরিস্থিতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র কিংবা জুলাই সনদ নিয়ে সচেতন নাগরিকরা সংশয়ে পড়ে গেছেন। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবচন আছে—‘নয় মণ ঘিও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না।’ ‘জুলাই সনদ’ নামের রাধাকে নাচাতে যে নয় মণ ঘি পোড়ানো, মানে জাতীয় ঐকমত্য দরকার, তার ছিটেফোঁটাও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন