‘ব্যাপার কী? আজকাল আবার আদি আমলের পুরান জুয়া খেলা ধরছেন নি? দান দান তিন দান!!’
‘আরে না বাবা, জুয়া তো দূরের কথা, এখন তো দাবা খেলার কথাও মুখে আনতে ভয় করে।’
‘ক্যেলা ক্যেলা, দাবা খেলা পৃথিবীর হক্কল খেলার মইধ্যে দি বেস্ট। বুদ্ধির খেলা দাবা, যারা দাবা খেলে হ্যেগো বেরেইন ভি শার্প হয়। আর আন্নে মিয়া দাবার নাম লইতে শরম পান!!’
‘না, বলছিলাম আফগানিস্তানে তালেবান সরকার দাবা খেলা ওদের দেশে ব্যান্ড করেছে। প্রকাশ্যে বা গোপনে জল-স্থলে-অন্তরীক্ষে কোনো স্থানে দাবা খেললে ধরা পড়লেই ফাঁসি!! তাই তোকে বলছিলাম তিন তাসের জুয়া তো দূরের কথা, দাবার নাম নিতেই ভয় লাগে; মাদার কান্ট্রির মতো কবে না বাংলাদেশেও দাবা ব্যান্ড করে দেয়।’
‘আরে না। আপনে জানেন মিয়া আমাগো নিয়াজ মোর্শেদ যখন দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার উপাধি জিতে তখন হালায় ভারত, পাকিস্তান, চীন, বার্মা, জাপান কুনো দেশেও একটা গ্র্যান্ডমাস্টার আছিল না। বুঝতে পারেন ১৯৮৭ সালে আমরা বাঙালিরা দাবায় ফার্স্ট। হেই বাংলাদেশে আপনে নি কন দাবা খেলা ব্যান্ড করব!!’
‘না, অনেকে তো দেখি এ.বি. সি.ডি. ই-ফোর ডি-ফোর, বাপ্পীরে পিন কর, ওরাও আলালের ঘরের দুলালের সাথে দীপ জ্বালিয়ে জুয়া খেলে।’
‘আরে মিয়া দশ টাকা, বিশ টাকা, এইডা কুনো জুয়া হোইলো!! ব্যেবাগতে মিল্লা চা-চু খায়া মুগ্ধ হোইবো হ্যের লাইগ্গা ট্যাকা লয়, এইডা জুয়া না!! তো আপনে যে তিন তাসের দান দান তিন দান খেলবেন হ্যেইডা পুরা জুয়া গ্যাম্বেলিং।’
‘কিন্তু সোনা, আমি তো দান দান তিন দান বলতে ফ্ল্যাশের জুয়ার কথা বলি নাই।’
‘মানে কী? টার্ম লোইবেন জুয়ার আর কোইবেন জুয়ার কথা বলি নাই!! তো আপনে দান দান তিন দান কোইতে কীয়ের কথা কোইছেন কন?’
‘না, আমি বলছিলাম, এই যে গত সরকারের পটপরিবর্তনের পর সবাই আশা করেছিলাম বাংলাদেশটা এবার সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে!! কিন্তু সকলি গরলে ভেল! যেই লাউ হেই কদু...’
‘তো আপনে কি ভাবছিলেন, বিগত সরকারের পতনের পর সারা বাংলার লুকেদের ডিএনএ চেঞ্জ হয়া যাইব!! হালায় হাগল নি কোনো!!’
‘না না, পাঁচই আগস্টের পর পুরো বাংলাদেশে এক মাস কোনো প্রকার চাঁদাবাজি হয়নি, তাই ভেবে ছিলাম জেন-জি, মানে এই জেনারেশনের তরুণরা আর যাই হোক, টাকার কাছে মাথানত করবে না। আর আমাদের প্রধান উপদেষ্টা পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর করবেন, ফলে মনে অনেক আশা জেগেছিল রে...’
‘তো অহন কি আশার গুড়ে বালি?’
‘তুই ভাবতে পারিস চাঁদাবাজি ছাড়া বাংলাদেশ। ভাবতেই আনন্দে গা শিওরে ওঠে।’
‘তো আপনের এই গা শিওরে ওঠার মইধ্যে জুয়ার দান দান তিন দান আইলো কোইথেইক্কা?’
‘না দ্যেখ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর, সারা বাংলার সাত কোটি জনগণ আশা করেছিল যে, জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে; বাংলার ঘরে ঘরে শান্তি বিরাজ করবে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকদের মতো আর বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হবে না। সারা বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হবে। জানিস তো, রাজা শশাঙ্কের সময় বাংলা ছিল সত্যিকার অর্থে ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা। আর ভারতবর্ষ সারা পৃথিবীর ২৭ শতাংশ অর্থনীতি কন্ট্রোল করত। বুঝতে পারিস পৃথিবীর অর্থনীতির ২৭ শতাংশ, যা ইউরোপের সব রাজ্যের যোগফলের চেয়েও বেশি।’
‘তো আপনের এই সোনার বাংলার বর্তমান হতদরিদ্র, নৈতিকতাবিহীন, নোংরা মানসিকতাসম্পন্ন এক অচ্ছুৎ জাতে ক্যেমনে রূপান্তরিত হোইলেন?’
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর তোদের ওইসব পূর্ব-পাকিস্তানের কেরানির পোলা, পিয়নের পোলা, পানিওয়ালার পোলা, কাজের বুয়ার পোলা, ড্রাইভারের পোলা, শেকসান অফিসারের মেয়ের জামাই সবাই রাজ্যভার হাতে পেয়ে টাকা-চুরি, ফেলে যাওয়া পাকিস্তানিদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, এখন যেমন তোরা পটপরিবর্তনের পর টয়লেটও দখল করিস তেমন আর কি? ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে সমাজের দিকটা আর দেখলি না। চোরচোট্টা হাইজ্যাকারে দেশটা ভরে উঠল।’
‘তো তখনকার ইয়ং জেনারেশন চ্যেতে নাই?’
‘চ্যেতব ক্যেমনে, একমাত্র বামপন্থি জনগণের দল ন্যাপ মানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি সব, মন্ত্রী হওয়ার লোভে সমাজের সাধারণের কথা ভুলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিলোপ করে। ওরা এখন বিলুপ্ত প্রজাতির এক প্রাণীতে পরিণত।’
‘এইডা কী কন, কমিউনিস্টদের মতো হাতুড়ি কাস্তে, দুনিয়ার মজদুর এক হও, যায়া আওয়ামী পদতলে নিজেরে সঁইপ্পা দিল!! লজ্জা লজ্জা!!’
‘তোর লজ্জা হতে পারে কিন্তু দেশের বারোটা বাজাল। তাই বলছিলাম ১৯৭১ বাংলাদেশ গড়ার একটা সুযোগ বা দান নষ্ট হয়েছে।’
‘দান দান তিন দান! ওরে এখন বুজছি, আপনে ক্যেন দান দান তিন দান কোইতাছেন!! আসলেই হেই মহেন্দ্রক্ষণে হতভাগা বাংলার গরিবদের ভাগ্য গড়ার একটা সুযোগ নষ্ট হোইছে।’
‘তখন যদি সেই সময়কার বাঘা বাঘা নেতা পয়সার লোভ না কোরতো, তাহলে এখন আর বুলডোজারের আঘাতে ওদের ঘরবাড়িও ভাঙত না আর বর্তমানে জুতার মালা পরে ইউনূস সরকারের বদনামও করতে পারত না।’
‘তারপর হো. মো. এরশাদ একটা চান্স...’
‘না না, সেনাবাহিনী না, তারপর দান আসছিল ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ আবার দেশ শাসনের ভার পেল। তখন এলো দ্বিতীয় দান। কিন্তু ওই ফকিন্নির পোলারা পয়সা পয়সা কোরে পুরো বাঙালি জাতির বারোটা বাজাল।’
‘আর দান দান তিন দান । অহন আপনে নি কন, যে বাংলাদেশ তৃতীয়বারের মতো সুযোগ পাইল দেশ গড়তে?’
‘জি, ৫ আগস্ট, এই হচ্ছে তোর দান দান তিন দান। এবার আবার এসেছে মহেন্দ্রক্ষণ। এবার যেই নির্বাচিত সরকার আসবে তারা যদি চায় তাহলে চাঁদাবাজি, বামাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি সব বন্ধ কোরে সোনার বাংলা গড়তে পারবে।’
‘স্বপ্ন দেখেন ঠিক আছে। কিন্তু দ্যেইখেন আপনের স্বপ্ন য্যেন দোষে ভইরা না যায়।’
‘তুই যত যাই বলিস, স্বপ্ন তোকে দেখতেই হবে। মানুষে বিশ্বাস কোরতেই হবে, কবি বলেছেন—মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ।’
‘দ্যেখেন ভবিষ্যতে আপনের মানুষে কী করে... দেশ গড়ে না দেশের... মারে...’
‘বড় আশা নিয়ে নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি রে...’
‘নির্বাচনের দিকে তাকায়া থাকেন, দ্যেখেন ভবিষ্যতে কী হয়...’
লেখক: চলচ্চিত্রকার ও রম্যলেখক
মন্তব্য করুন