আঃ ছালাম খান
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহররমের প্রথম দশ দিন

ইতিহাস, ফজিলত আমল ও করণীয়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘মহররম’। এটি ‘আশহুরে হুরুম’ বা সম্মানিত চার মাসের একটি, যার প্রতি আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ মাসের প্রথম দশ দিন বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ, রহমত, বরকত ও ইবাদতের উজ্জ্বল সুযোগ। ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মত্যাগের অপূর্ব মেলবন্ধনে মোড়ানো এ সময় আমাদের ইমান, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধকে নতুন করে জাগ্রত করার আহ্বান জানায়।

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এই দশ দিন শুধু আবেগ নয়; আত্মশুদ্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসার উপলক্ষ। ইসলামী ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেমন আশুরা দিবস, তেমনিভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এ মাসকেই দিয়েছে অমরতা।

মহররম: ইতিহাসের আয়নায়

ক. প্রাক-ইসলামিক আরব সমাজে মহররম: আরবরা মহররমকে সম্মান করত। তারা এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, খুনখারাবি বন্ধ রাখত। ইসলাম আবির্ভাবের পরও এ সম্মান অক্ষুণ্ন থাকে। কোরআনের সুরা তওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ‘আল্লাহর নিকট মাস গণনায় বারো মাসই, যার মধ্যে চারটি সম্মানিত।’

খ. আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

মহররমের ১০ তারিখ, ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। বহু নবীর জীবনে এই দিনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে: হজরত মুসা (আ.)-এর বনি ইসরাইল ফেরাউন থেকে মুক্তি পায়।

হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা তুফান শেষে পাহাড়ে থামে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) আগুন থেকে রক্ষা পান।

হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন।

হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়।

গ. কারবালার মহাকাব্যিক অধ্যায়

৬১ হিজরি, ১০ মহররম ইসলামের ইতিহাসে গভীর শোক ও গৌরবের দিন। ইয়াজিদের জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পথে দাঁড়িয়েছিলেন রাসুল (সা.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন (রা.)। পরিবারসহ তিনি কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন। এই ত্যাগ শুধু ইতিহাস নয়, ইসলামের আত্মা হয়ে চিরকাল মুসলমানদের কাছে সত্য ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছে।

ফজিলত ও আমলের নির্দেশনা

ক. কোরআন ও হাদিসের আলোকে

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘রমজান মাসের পর আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা।’ (সহিহ মুসলিম)। আবার আশুরার দিনে রোজা রাখার প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘আশা করি আল্লাহতায়ালা এ রোজার মাধ্যমে অতীত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম)

খ. আশুরার রোজা

রাসুল (সা.) ইহুদিদের আশুরার রোজা পালনের কথা শুনে বলেছিলেন: ‘তোমরা দশমের সঙ্গে নবম অথবা একাদশ মিলিয়ে রোজা রাখো, যাতে ইহুদিদের থেকে ভিন্ন হওয়া যায়।’

গ. মহররমের প্রথম দশ দিনের করণীয় আমল—

কোরআন তেলাওয়াত বৃদ্ধি করা; ইস্তিগফার ও তওবা করা; দান-সদকা করা; অতীত গোনাহর জন্য কান্না ও আত্মসমালোচনা; আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি সাহাবা ও আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ।

সামাজিক ও আত্মিক উপলব্ধি

ক. কারবালা: প্রতিরোধের শিক্ষা

ইমাম হোসাইন (রা.) কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক আদর্শ। ক্ষমতার লোভ, সত্যকে চাপা দেওয়া, ধর্মের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি একা দাঁড়িয়েছিলেন। তার ত্যাগ মুসলিম সমাজকে আজও শিক্ষা দেয়—বিপদের মধ্যেও ন্যায় পথ থেকে বিচ্যুতি নয়।

খ. মহররম ও প্রতিবাদ সংস্কৃতি

আধুনিক পৃথিবীতে যখন অত্যাচার, দুর্নীতি ও অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন কারবালার চেতনা আমাদের শেখায়, ‘সত্য কথা বলো, যতই শক্তির বিরুদ্ধে হোক।’

মহররম শুধু কান্না করতে শেখায় না, প্রতিবাদ করতে শেখায়।

গ. আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে বদলে ফেলা

মহররম আত্মসমালোচনার মাস। নববর্ষের শুরুতেই আমাদের উচিত অভ্যন্তরীণ দূষণ দূর করা, অহংকার ও হিংসা দূর করা, হৃদয়কে পরিষ্কার করা।

আহলে বাইতের ভালোবাসা ও সম্মান

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত শুধু শোক নয়, দায়িত্বের আহ্বান। রাসুল (সা.) বলতেন, ‘হোসাইন আমারই অংশ, আমি হোসাইনের অংশ।’ তার ভালোবাসা থাকা ইমানের অংশ। আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা মানেই হলো সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অটল থাকা।

বিদআত ও ভ্রান্ত রীতি সম্পর্কে সচেতনতা

মহররম উপলক্ষে অনেক জায়গায় কিছু কুসংস্কার ও বেদআত প্রচলিত হয়ে গেছে, যেমন—নিজের শরীর আঘাত করা; তাজিয়া মিছিলের নামে বিশৃঙ্খলা; ‘পাক রান্না’ করে তা অলৌকিক মনে করা। এসব ইসলাম স্বীকৃত নয়। আমাদের উচিত রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী এ মাস পালন করা— ইবাদত, রোজা, তওবা ও সৎকর্মের মাধ্যমে। মহররমের গুরুত্ব ও শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা ও ইসলামী ইতিহাস চর্চা বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জীবনভিত্তিক নাটিকা, আবৃত্তি বা বক্তৃতা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা; টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে ইতিহাসনিষ্ঠ ও শুদ্ধ বার্তা তুলে ধরা।

কারবালার ইতিহাস যেন শুধু শোক নয়, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের অনুপ্রেরণা হয়। মহররম আমাদের জন্য শুধু একটি মাস নয়; এটি একটি চেতনা, একটি সংগ্রাম, একটি বোধ। সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গের প্রতীক এই মাস। হোসাইন (রা.) আমাদের শেখান, সংখ্যায় বড় না হয়েও ন্যায়ের পথে অটল থাকা যায়, অন্যায়ের সামনে মাথানত করা যায় না।

মহররমের প্রথম দশ দিন আমাদের চিন্তা, চরিত্র ও কর্মে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যদি আমরা তা বুঝে উপলব্ধি করি। এ মাসে কান্না করা উচিত। তবে নিজের গোনাহর জন্য। এ মাসে রোজা রাখা উচিত। তবে আত্মাকে খাঁটি করার জন্য। এ মাসে শোক করা উচিত। তবে সেই আদর্শের জন্য, যা জীবনকে আলোকিত করে।

আসুন, মহররমের প্রথম দশ দিনকে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত, ত্যাগ ও নৈতিকতা অর্জন হিসেবে গ্রহণ করি। কারবালার ত্যাগ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সত্য, শান্তি ও ইনসাফের পথে গড়ে তুলি।

লেখক: মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

[email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভুয়া তথ্য’ রুখতে জাতিসংঘের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর সেই বিধবা পেলেন সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসায় সময়সীমা আরোপের উদ্যোগ

তাসকিন-তানজিমে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা, কলম্বোতে শুরুতেই টাইগারদের দাপট

মুদি দোকানে মিলল টিসিবির ১৪৪২ লিটার তেল 

বিমানে যাত্রীদের সঙ্গে উঠে গেল সাপ, অতঃপর...

সংসদ নির্বাচনে ৪৮ লাখ ডলার দিচ্ছে জাপান

১২ কেজি এলপিজির দাম কমলো 

সরকারি অফিসে ৫০ ভাগ লোক কাজ করে না : আসিফ নজরুল

গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্রমিক দল-ছাত্রদলের ৩ নেতা বহিষ্কার

১০

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় বিপিসির উদ্বেগ 

১১

ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে ‘মুক্তির পাঠাগার’ স্থাপন করল ছাত্রদল নেতা

১২

চলে গেলেন জীনাত রেহানা

১৩

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রে দোয়া মাহফিল 

১৪

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের বড় ঘোষণা

১৫

ডিম বাছাইকে কেন্দ্র করে দোকানিকে ছুরিকাঘাত

১৬

কাজাখস্তানে প্রকাশ্যে মুখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা

১৭

তেজগাঁও থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রিয়াল উদ্ধার, আটক ৬

১৮

মাইক্রোবাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ২

১৯

আরেক আ.লীগ নেতার কারাদণ্ড

২০
X