নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ ইতিহাসের অবসান ঘটল।’ সেই সময়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেমন একদিকে স্নায়ুযুদ্ধের ইতি টেনেছে, অন্যদিকে উদারতাবাদী গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে। এভাবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা নতুন করে অঙ্কন করেছিল আমেরিকান সরকার।
এদিকে নিজের শক্তি পুনর্গঠন করতে রাশিয়ার লেগে যায় দুই দশক সময়। সেই হারানো শক্তি ফিরে পাওয়ার পরই তারা হামলা চালায় প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র—জর্জিয়া ও ইউক্রেনের ওপর। আবার এ স্বল্প সময়ের মধ্যে পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আত্মবিশ্বাসী এক চীন। আজকের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করে দিয়েছে, ইতিহাসের কোনো অবসান ঘটেনি, বরং মোড় নিয়ে নতুন পথে চলতে শুরু করেছে ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যে বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল, তার ভিত্তি ছিল উদার গণতন্ত্র। আজ সেই ব্যবস্থা নিজস্ব কাঠামো থেকে সরে এসে আত্মপরিচয় সংকটে পতিত হয়েছে।
সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পশ্চিমা গণমাধ্যমে আবারও পুরোনো এক শিরোনাম দেখা যাচ্ছে—‘নতুন করে গড়ে উঠতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য।’ বলা হচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়েছে ইরানের প্রতিরোধ বলয়। সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় নাকি তাদের প্রভাব কমে গেছে। কিন্তু এই দাবি নতুন নয়। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রতিটি দশকেই অন্তত একবার করে হলেও এমনটা দাবি করা হয়েছে। পশ্চিমাদের মদদে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং তাদের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড ভাগ করে দেওয়ার পর সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য যুদ্ধ। প্রতিটি যুদ্ধের পর তাদের গণমাধ্যমগুলোতে একই সুর শোনা গেছে—‘এবার নতুন যুগের সূচনা হবে, মধ্যপ্রাচ্য আবার বিকশিত হবে।’ অথচ সেই আকাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটতে দেখা যায়নি, বরং প্রত্যেকটি যুদ্ধ পরবর্তী সংঘাতের বীজ বপন করেছে।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে একে একে তিনটি আরবীয় দেশের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ইসরায়েল। এরপর সিনাই উপদ্বীপ, গোলান উপত্যকা এবং ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূখণ্ড দখল করে নেয় তারা। কিন্তু এ বিজয়ের ছায়াতেই উত্থান ঘটে ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের; সেটা হলো ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) প্রতিষ্ঠা। প্রাথমিক পর্যায়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল পিএলও। কিন্তু তৎকালীন সরকারগুলোর পতনের পর নিজেদের কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় ফিলিস্তিনিরা। শুরুতে আরব অঞ্চলের শাসকরা নিজ নিজ কৌশলগত প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও, পরবর্তীকালে সংস্থাটিকে ফিলিস্তিনিরা তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠন করে নেয়।
আবার ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমণ করে তার রাজধানী বৈরুত পর্যন্ত পৌঁছে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। দক্ষিণ লেবানন পুরোপুরিভাবে দখল করে নেয় তারা। কিন্তু সেই বিজয়ের অন্তরালে জন্ম নেয় হিজবুল্লাহর মতো একটি শক্তিশালী প্রতিরোধী সংগঠন, যা গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের জন্য একটি অবিচ্ছিন্ন হুমকি হয়ে আছে। আরব সরকারগুলো নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তির মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হলেও, ইসরায়েল তাদের একত্রীকরণের ফলাফলের প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে। এটা যেন কখনো বাস্তব রূপ না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে সর্বদাই তৎপর রয়েছে ইসরায়েলি শক্তি।
আরব বসন্তের সূচনালগ্নে যখন তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জিনে আল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে এবং মিশরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন এই গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিহত করতে উঠে-পড়ে লাগে ইসরায়েল। বিশেষত মিশরকে প্রধান লক্ষ্য করে তারা। এর পেছনে যে মোক্ষম কারণ ছিল তা হলো, মিশরীয় জনগণ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ—দুটোরই ঘোরতর বিরোধী ছিল। তাই ২০১৩ সালে মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসনকে বৈধতা দিতে ওয়াশিংটনে নিজেদের প্রভাব কাজে লাগায় ইসরায়েল।
‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ ইসরায়েলের বহু পুরোনো কল্পচিত্র, যা বাস্তবে এক অলীক কাহিনি। কারণ, এ পরিকল্পনার শর্তগুলো এমন যে, কোনো নীতিবান আরব শাসক তা মেনে নিতে পারে না। আরব রাষ্ট্রগুলো আপসের পথ বেছে নিলেও, ইসরায়েলের গগনচুম্বী চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে না। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর ঘটনার ঠিক আগে, সৌদি আরব আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এমনটা ঘটলে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার ব্যপারটি ধামাচাপা দিতে সহযোগিতা করবে সৌদি সরকার। ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব অর্জন ও ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে যাবে।
গাজা ও লেবাননে দীর্ঘমেয়াদি হামলার পর ইসরায়েল গত মাসে আকস্মিক হামলা করেছে ইরানের ওপর। আর ফের একবার ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী অভিযানকে সমর্থন দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। এ হামলার দরুণ ঝুঁকিতে ছিল লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। কিন্তু সেই ব্যাপারে পশ্চিমাদের খুব বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়নি। কারণ এ প্রাণগুলো ছিল ইরানি প্রাণ, ইউরোপীয় বা ইসরায়েলি নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা শুধু একটি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘনই নয়, একই সঙ্গে এটা তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যের স্পষ্ট অবমূল্যায়ন। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রকাশ করা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইরানের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই। সেই প্রতিবেদন অগ্রাহ্য করে ইসরায়েলের অনুরোধে ইরানে হামলা চালিয়েছে আমেরিকান বাহিনী। এ ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দিল যে, আন্তর্জাতিক আইন শুধু তখনই প্রযোজ্য, যখন তা পশ্চিমা স্বার্থের অনুকূলে থাকে।
‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ কথাটি পশ্চিমা নেতারা প্রায় ধর্মমন্ত্রের মতো মুখস্থ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক গতিধারা প্রতি দশকে নতুন মোড় নেয়। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমনটি দেখা যায় না। ইসরায়েল-ইরান সাম্প্রতিক যুদ্ধ আমাদের কিছু গভীর শিক্ষা দিয়েছে। এই যুদ্ধে কারও নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটেনি, বরং উন্মোচিত হয়েছে উভয়পক্ষের সামরিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতা। একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুর্বলতাগুলোও। একদিকে যেমন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজ দেশের অভ্যন্তরে তার শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে ইরানে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শাসনব্যবস্থা যুদ্ধের পরও পূর্ণ জনসমর্থনে টিকে আছে। ফলে ভবিষ্যতে এ দুপক্ষের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক।
অন্যদিকে, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের দরুন অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের অসহায়ত্ব এবং সামরিক দিক দিয়ে তাদের কার্যত অনুপস্থিতি সবার নজরে পড়েছে। যুদ্ধ চলাকালে ড্রোন আঘাতে জর্ডানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দেওয়ার পর উপসাগরীয় দেশগুলো আত্মরক্ষার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে দুটো ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটা হলো সংঘর্ষের দরুণ আরব রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার অক্ষমতা এবং অন্যটি হলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব।
এ সংঘর্ষের কারণে আরব অঞ্চলের রাজনীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। যেমন, ইরান আবারও মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিকভাবে তৎপর হয়ে উঠবে। ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ায় নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইবে তারা। এরই মধ্যে তারা নিজেদের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একমাত্র শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সরকারের ওপর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন এমন নীতিমালা বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে তারা, যার দ্বারা ফিলিস্তিনিদের গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে জোরপূর্বক বিতাড়ন করা হবে বলে মনে হচ্ছে। এমনটা ঘটলে তার মাশুল দিতে হবে আরব রাষ্ট্রগুলোকেই, কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রকে নয়।
ইসরায়েল ও ইরান যখন মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোর ভূমিকা হয়ে উঠছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাজায় গণহত্যা শুরু হয়েছে প্রায় দুই বছর হলো। ফিলিস্তিনেদের ওপর ইসরায়েলের এ হত্যাযজ্ঞ থামাতে কেউ এগিয়ে আসছে না। আরব রাষ্ট্রগুলোর এখন নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামী রক্ষণশীলতা—এ দুইয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে তাদের। নতুবা যুদ্ধে শুধু নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে রয়ে যাবে তারা। এ দ্বন্দ্বে মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ জনগণই আজ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ।
এ কথা সত্য যে, আরব রাষ্ট্রগুলোর সত্যিকার অর্থেই ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গঠনের স্বপ্ন দেখা উচিত। তবে পশ্চিমাদের দেখানো স্বপ্ন হলে চলবে না, সেটা হতে হবে তাদের নিজেদের দেখা স্বপ্ন। মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের স্বার্থরক্ষা করতে হলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের নকশা আরবদের হাতেই গড়তে হবে। বাহ্যিক কোনো শক্তি, হোক সেটা পশ্চিমা কিংবা পূর্বী, সেই পরিকল্পনার পরিদর্শক বা পরোক্ষ অংশীদার হতে পারে, কিন্তু তাদের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নির্দেশকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করা চলবে না।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং তেল আবিব নগর পরিষদের সাবেক ফিলিস্তিনি নেতা। নিবন্ধটি মিডল ইস্ট আইয়ের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন