‘স্যার’ শব্দটির প্রতি কিছু মানুষের দুর্বলতা অপরিসীম। এটি একটি তৈলাক্ত শব্দ। কাউকে তৈলমর্দন করার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকরী। কায়দাকানুন করে এ শব্দের চৌকস প্রয়োগ কোনো কিছু আদায় করার ক্ষেত্রে ধন্বন্তরীর কাজ করে। বারবার স্যার স্যার বলে হাত কচলালে কর্তাব্যক্তিরা বিগলিত হন। যেমন গরম কড়াইয়ে জমাটবাঁধা মাখন দিলে তা নিমিষেই গলে যায়। আর যদি আপনার বাক্যে স্যার শব্দটি গরহাজির থাকে, কিংবা তা অন্তরের অন্তস্তল থেকে নির্গত না হয়, তাহলে কর্তাব্যক্তি আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবেন, যেন আপনি রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
সেই স্যার এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গত ১০ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নারী কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধন প্রথা বাতিল করা হয়েছে। তবে তাদের এখন থেকে কী অভিধায় সম্বোধন করা হবে, সরকারের ঘোষণায় তা বলা হয়নি। স্মর্তব্য, ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা ফরমান জারি করেন যে, তাকে ‘ম্যাডাম’ ডাকা যাবে না, ডাকতে হবে স্যার। অবশ্য সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপনে এর অন্তর্নিহিত কারণ জানানো হয়নি। তবে তখন শেখ হাসিনার গুণমুগ্ধরা বলতেন যে, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদটির ‘স্ত্রী লিঙ্গ’ নেই, তাই ব্যক্তি শেখ হাসিনা নারী হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো লিঙ্গ, মানে জেন্ডার নেই। সুতরাং তাকে স্যার ডাকাই যৌক্তিক এবং এটি ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’র একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। খবরটি যখন চাউর হলো, তখন অনেকেই মুখ টিপে হেসে মন্তব্য করেছিলেন, তাহলে কচিৎ-কদাচিৎ অলৌকিকভাবে নারীর পুরুষ হওয়ার যেসব খবর শোনা যায়, এ ক্ষেত্রেও কি তেমন কিছু ঘটেছে? চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেন, মানবদেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় নারী পুরুষ কিংবা পুরুষ নারীতে পরিণত হতে পারে। তবে তা অত্যন্ত বিরল। অবশ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের এ উৎকর্ষের সময়ে সার্জারির দ্বারা পুরুষকে নারী কিংবা নারীকে পুরুষকে রূপান্তরিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের পার্লামেন্টকেও টেক্কা দিয়েছে বিজ্ঞান। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অসীম ক্ষমতার বিষয়টি বোঝানোর জন্য বলা হয়ে থাকে, ‘ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া সব করতে পারে।’ একবিংশ শতাব্দীতে এসে চিকিৎসাবিজ্ঞান সে অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। এটা বিজ্ঞানের অনন্য সাফল্য সন্দেহ নেই। নারী থাকতে থাকতে কারও অরুচি ধরে গেলে সে সহজেই পুরুষে পরিণত হতে পারে। আবার পুরুষও পারে নারীত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে।
সাবেক এবং ‘পতিত’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরুষ হওয়ার জন্য নিজেকে স্যার ডাকার ফরমান জারি করেননি, এটা না বললেও বোঝা যায়। সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক কারণে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। যেহেতু বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সবাই ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করেন, তাই শেখ হাসিনার ছিল ওই শব্দটির প্রতি মারাত্মক এলার্জি। যে খাবারে যার এলার্জির প্রবণতা থাকে, মানুষ সে খাবার যেমন এড়িয়ে চলে, শেখ হাসিনাও ম্যাডাম শব্দটি পরিহার করতে চেয়েছিলেন। তিনি কারও মুখে ওই সম্বোধন শুনতে চাননি। প্রথমদিকে শুধু তার বেলায়ই ওই নিয়মটি চালু ছিল। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে রীতিমতো পরিপত্র জারি করে বাংলাদেশের তাবৎ অফিস-আদালতে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনের প্রথা চালু করেন। বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ গদিতে সমাসীন হয়ে দেশে হাজারটা সমস্যার জন্মদাত্রীর এই একটি অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলে কেউ বোধকরি সময়ের অপচয় করতে প্রবৃত্ত হননি। অবশ্য কেউ কেউ রসের হাঁড়িতে জিহ্বা চুবিয়ে যে বাক্যটি উগড়ে দিয়েছিলেন তা হলো, যেখানে আমাদের সরকার বাহাদুর নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী, সেখানে সম্বোধনের ক্ষেত্রে কেন বৈষম্য থাকবে? সুতরাং নারী কর্মকর্তাদের স্যার ডাকার বিধান করে শেখ হাসিনা যুগান্তকারী একটি কাজ করেছেন। এজন্য অন্তত তার নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওই মহার্ঘ্য বস্তুটি এখনো পর্যন্ত তার কাছে সোনার হরিণ হয়ে থাকলেও দেশের এক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক তাকে একটি নভেলের নাম উপহার দিয়েছেন। ‘নয় মাস’ নামে প্রকাশিত নিজের একটি উপন্যাসের ভূমিকায় ওই লেখক বলেছেন, উপন্যাসটির নাম তিনি রেখেছিলেন ‘পাকিস্তানি’। কোনো এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দেখা হলে ‘এখন কী লিখছেন’ জানতে চাইলে ঔপন্যাসিক মহাশয় পাকিস্তানির কথা জানান। তখন শেখ হাসিনা তাকে উপন্যাসটির নাম পরিবর্তনের পরামর্শ দেন এবং তিনি সে পরামর্শকে শিরোধার্য করে নামটি পাল্টে ‘নয় মাস’ রাখেন। লেখক প্রবর ওই সময় শেখ হাসিনাকে স্যার ডেকেছিলেন কি না, তা অবশ্য বলেননি। তবে এটা যে তৈলমর্দনের একটি আধুনিক ও অভিনব পদ্ধতি ছিল, তা বেশ বোঝা যায়। জিহ্বা যাদের ধারালো, তারা মন্তব্য করেছিলেন, ভাগ্যিস শেখ হাসিনা ঔপন্যাসিক মহোদয়কে তার বউ পরিবর্তনের নির্দেশ দেননি। দিলে হয়তো আমাদের বিক্রমপুরের এক নারীর সংসারের পাশাপাশি কপালটাও ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। সেই ঔপন্যাসিকের নাম-পরিচয় প্রকাশ সংগত নয়। তবে একটু ইঙ্গিত দিই—তার নামের সংক্ষিপ্তাকার ‘ইহমি’।
যাহোক, অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে একটি অযৌক্তিক সম্বোধন থেকে দেশের সরকারি অফিসের লোকজন রেহাই পেল, এটা কম কথা নয়। এমনিতে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করলেও এ সিদ্ধান্তটির সমালোচনা কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তবে স্যার শব্দটির প্রতি একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রবল দুর্বলতা রয়েছে। তারা অধীনদের কাছ থেকে তো বটেই, দেশের সবার কাছ থেকে স্যার সম্বোধন প্রত্যাশা করেন। স্যার না বললে তারা বড়ই রুষ্ট হন। মুখে কিছু না বললেও কাজে বুঝিয়ে দেন, তিনি বেজায় অসন্তুষ্ট।
ইংরেজি স্যার শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ জনাব, মশাই, মহোদয়, মহাশয় ইত্যাদি। কিন্তু এসব বাংলা শব্দ অনেকেরই রুচে না। তারা স্যার শুনতেই অতীব আগ্রহী। শব্দের ঐতিহাসিক সূত্রমতে, স্যার পুরুষদের জন্য ইংরেজিতে একটি সম্মানসূচক আনুষ্ঠানিক সম্বোধন। উচ্চ মধ্যযুগের ‘Sire’ থেকে এর উৎপত্তি। পুরোনো ফরাসি শব্দ ‘সিউর’ মানে লর্ড থেকে উদ্ভূত। ফরাসিভাষী নর্মানিদের দ্বারা তা ইংল্যান্ডে অভিবাসী হয়েছিল, যা এখন ফরাসি ভাষায় শুধু ‘মন্সিউর’-এর অংশ হিসেবে বিদ্যমান। নর্মানরা মূলত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, এরা বাস করত উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। সময়ের বিবর্তনে তারা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখান থেকেই ‘Sire’ শব্দটি ইংল্যান্ডে তাশরিফ আনে এবং রূপান্তরিত হয় ‘স্যার’-এ। এটা ইংরেজি লর্ড শব্দের সমতুল্য। ঐতিহ্যগতভাবে, আইন ও প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিসেবে স্যার সেসব পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য, যারা নাইট (Knight) উপাধিপ্রাপ্ত হন। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে স্যারের সমমর্যাদার সম্বোধন শব্দ ‘ম্যাডাম’, যা এখন সংক্ষিপ্ত ‘ম্যাম’-এ রূপ নিয়েছে। বাঙালিদের মধ্যে ভারতের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলাদেশে ব্র্যাকের পরলোকগত চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ নাইট উপাধি পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করে মানবতার প্রতি তার শ্রদ্ধাশীলতার নজির স্থাপন করে গেছেন।
স্যার যেহেতু একটি সম্মানসূচক শব্দ, তাই সম্মানিত ব্যক্তিদের এ সম্বোধনে কারও আপত্তি থাকারও কথা নয়। বিশেষ করে যারা চাকরি করেন, উপরস্থ কর্মকর্তাকে তারা স্যার সম্বোধন করবেন, এটাই প্রচলিত শিষ্টাচার। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের শ্রদ্ধাভরেই স্যার সম্বোধন করে থাকেন। তবে কোনো কর্মকর্তা যখন নিজেকে স্যার সম্বোধন না করায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন এবং সম্বোধনকারীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন, তখন তা নিয়ে কথা না বলে উপায় থাকে না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিসি-ইউএনওকে স্যার না বলায় নিরীহ ব্যক্তিদের হেনস্তা করার বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর গণমাধ্যমে বেরিয়েছিল।
আমাদের দেশের সরকারি আমলারা স্যার শব্দটির প্রতি কতটা বুভুক্ষ তার একটি উদাহরণ দিই। বলে নিই, আমি আমার শিক্ষক এবং চাকরি ক্ষেত্রে সরাসরি বসের বাইরে হাতেগোনা দু-চারজনকে স্যার সম্বোধন করতাম। তাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বি চৌধুরী একজন। যাহোক, আমি যখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব তখন ঢাকার জেলা প্রশাসক ছিলেন জনৈক সৈয়দ সাহেব। তার পুরো নামের বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় সৈয়দ ঘোষক মুসলিম। চাকরিসূত্রেই তার সঙ্গে পরিচয়। একজন সৎ মানুষ হিসেবে তাকে আমি বেশ সম্মান করতাম। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তিনি যুগ্ম সচিব হন। পরে সচিব হিসেবে অবসরে যান। একদিন ফেসবুকে তার প্রোফাইল দেখে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাই। তিনি গ্রহণ করেন। এরপর আমি মেসেঞ্জারে তাকে লিখি—‘ভাই কেমন আছেন?’ ব্যস, ফসফরাসের মতো জ্বলে উঠলেন তিনি। আমার বাংলা প্রশ্নের জবাবে তিনি ইংরেজিতে নাতিদীর্ঘ যে রচনা লিখে পাঠালেন, তার বাংলা তর্জমা দাঁড়ায়—“হাজারো মানুষ আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে। আপনি কেন আমাকে তা করবেন না? যদি স্যার সম্বোধন করতে না পারেন, তাহলে বন্ধুতালিকা থেকে সরে যাওয়াই ভালো।” সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে ত্রিশ বছর আগের আমি জেগে উঠল। আমি তাকে লিখলাম, সৈয়দ সাব, আপনি জানেন আমি রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিক। সিনিয়র সহকারী সচিবের পদমর্যাদায় আমি ম্যাডামের সহকারী প্রেস সচিবের চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বে ছিলাম। আপনি তখন ঢাকার ডিসি, পদমর্যাদা ছিল উপসচিব। অর্থাৎ আমার চেয়ে একধাপ ওপরে। যদি ওয়ান-ইলেভেনের গজব নাজিল না হতো, তাহলে আমি হয়তো আরও অনেক আগেই এমপি-মন্ত্রী হয়ে যেতে পারতাম। তখন আপনি আমাকে স্যার ডাকতে বাধ্য থাকতেন। শুনুন ভাই, জোরজবরদস্তি করে মানুষকে দিয়ে স্যার ডাকিয়ে প্রকৃত সম্মান পাওয়া যায় না। সম্মান-শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয় মানুষকে মর্যাদা দিয়ে।’ এখানেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতি।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন