সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং পরিবেশবিদদের একাধিক সতর্কবার্তা সত্ত্বেও নীলফামারীর ডিমলায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা। উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার, রাস্তার পাশ ও নার্সারিতে এই চারা বিক্রি চলছে প্রকাশ্যেই। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ সচেতন নাগরিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
সম্প্রতি উপজেলার কলোনি বাজার, ডাঙ্গারহাট, একতা বাজার, ডালিয়া নতুন বাজার, চাপানিহাট, নাউতারা বাজার ও শুটিবাড়ি বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন নার্সারি ও চারা বিক্রেতারা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন।
অথচ ২০২৪ সালের ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছকে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ ঘোষণা করে এসব গাছের চারা উৎপাদন, রোপণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা রোপণ, উত্তোলন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলো।
তবুও ডিমলার বাজারগুলোতে এসব নিষিদ্ধ গাছের চারা বিক্রি চলছে নির্বিঘ্নে। চাপানি বাজারের এক বিক্রেতা বলেন, মানুষ এই গাছ চায়, আগেই চারা এনেছি। এখন বিক্রি না করলে লোকসান হবে। কেউ তো কিছু বলছে না।
অন্যদিকে এক কৃষক জানান, এই গাছ দ্রুত বাড়ে, তাই চাষ করি। তবে শুনেছি এর আশপাশে অন্য গাছ ভালো হয় না।
স্থানীয় কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, বিগত বছর নিজের জমিতে ৫০টি ইউক্যালিপটাস গাছ লাগাই। এবার পাশের ধানের জমিতে পানি টিকছে না। পরে বুঝেছি, গাছগুলোর কারণেই নিচের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
আরেক কৃষক রোকনুজ্জামান বলেন, এই গাছ দ্রুত বাড়ে, কাঠ বিক্রি করে লাভ হয়। কিন্তু আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে, ফলগাছ ফল দিচ্ছে না। এখন বুঝছি, এটা ক্ষতিরই বেশি।
পরিবেশবিদদের মতে, ইউক্যালিপটাস গাছ ভূগর্ভস্থ পানি শোষণ করে মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, আকাশমনি গাছ থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ আশপাশের উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ে।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, একটি পরিপক্ব ইউক্যালিপটাস গাছ বছরে ৯০ থেকে ১২০ লিটার ভূগর্ভস্থ পানি শোষণ করে। এসব গাছের এলাকায় গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে। দেশের ৪৫টি জেলায় জলস্তর গড়পড়তা ১ দশমিক ৮ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
নীলফামারী জেলা পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এই চারা বিক্রি বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে পানির স্তর ভয়াবহভাবে নিচে নেমে যাবে। শুধু কাগজে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে লাভ নেই, বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মাঠে নামতেই হবে।
নীলফামারী জেলা পরিবেশ সংরক্ষণ ফোরামের সমন্বয়ক মো. মাহমুদ হাসান বলেন, এই গাছগুলো পরিবেশে এক ধরনের ‘সবুজ মরুভূমি’ তৈরি করছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ভয়াবহ জলাভাব ও কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে।
রংপুর বন বিভাগের ডিমলা বিট কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, বন বিভাগের আওতাধীন কোনো নার্সারিতে ইউক্যালিপটাস বা আকাশমনি চারা উৎপাদন বা বিক্রি হচ্ছে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হাসান আল বান্না বলেন, বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব নয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান বলেন, নিষিদ্ধ গাছের চারা উৎপাদন ও বিপণন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জনগণকে পরিবেশবান্ধব গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন