জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্রান্তিকালের কথকতা

একুশ শতকের আইকনিক বিপ্লবী

একুশ শতকের আইকনিক বিপ্লবী

আজ ১৬ জুলাই। বর্ষা বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আবু সাঈদ কোন দলের কর্মী, কী তার রাজনৈতিক পরিচয়, এসব বিষয় এখন মুখ্য নয়, গৌণ। তার আসল পরিচয় তিনি ফ্যাসিবাদী বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বুলেটের ভয়ে তিনি ভীত হননি। বন্দুকের সামনে বুক টান করে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবিটি মুহূর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। চব্বিশের জুলাইয়ের প্রথম দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়াতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামতে শুরু করেন। তাদের মাথায় বাঁধা জাতীয় পতাকা। হাতে প্রমাণ সাইজের জাতীয় পতাকা। তাদেরই একজন ছিলেন আবু সাঈদ। আবু সাঈদ এখন একুশ শতকের এক আইকনিক বিপ্লবী।

কিছু কিছু দুঃখ আছে একান্তই ব্যক্তিগত, কিছু কিছু দুঃখ আছে সামাজিক। দুই ধরনের দুঃখকেই জানতেন আবু সাঈদ। এ বোধের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, কেননা অভাবের সঙ্গে ছিল তার নিত্যবসবাস। আমাদের এ সমাজে লুটেরাদের জয়জয়কার। এখানে গরিব অসহায় মানুষের কোনো মূল্য নেই; সমাজের সর্বস্তরে তারা উপেক্ষিত। আবু সাঈদের জন্ম কুড়িগ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে। তিনি ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অতিদরিদ্র বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে আবু সাঈদ একজন। অর্থাভাবে ছেলের লেখাপড়া হওয়া দুঃসাধ্যই ছিল। কিন্তু আবু সাঈদ স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নিজের প্রিয় বিষয় ইংরেজি নিয়ে। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতেন। সঙ্গে বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতেন মাসে মাসে। দেশজুড়ে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল, আবু সাঈদ ছিলেন তার একেবারে সামনের সারিতে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ের ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদের পরনে সাদা-কালো চেক শার্ট। চোখে চশমা। ভিডিও ক্লিপটা বড়জোড় মিনিটখানেক! আবু সাইদের মুখে কোমল দাড়ি-গোঁফ। পরনে কালো গোল গলা টিশার্ট আর ধূসর প্যান্ট। পায়ে ধূলিধূসরিত জুতা। দুটি হাত দেহের সঙ্গে সমান্তরালে আড়াআড়ি ছড়ানো। ডান হাতে একটা ছোট লাঠি নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বুলেটের মুখোমুখি। একেবারে একা। সহসা গুলির শব্দ। আবু সাঈদের শরীরে একটা আলতো ঝাঁকুনি লাগল। আবার কয়েকটি গুলির শব্দ। দেখা গেল—হাতের লাঠি দিয়ে তিনি বুলেট আটকানোর চেষ্টা করছেন! একটু বিস্ময় তার দৃষ্টিতে। হয়তো ভাবছিলেন, তিনি তো আক্রমণ করিনি! তিনি তো বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে এক মৌন প্রতিবাদ জানাচ্ছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে! তিনি তো কোনো অপরাধ করিনি! তা সত্ত্বেও কেন গুলি করছে ওরা! উত্তরটা সহজ, আবু সাঈদ বুঝতে পারেননি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর ফ্যাসিবাদের যে অনুভূতিহীন দানব জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে, তিনি এসব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তোয়াক্কা করেন না। অতএব বুলেটবৃষ্টি হতেই থাকল। এক একটা করে বুলেট এসে লাগছিল আবু সাঈদের বুকে, আর তিনি এক একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছনের ধাপ বেয়ে ঘাসের চত্বরে উঠে গেলেন। তারপর দুই পায়ের আঙুলগুলোর ওপর ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে পড়লেন।

ডান দিক থেকে দৌড়ে এলেন একজন। ডান হাত ধরে টেনে তুললেন তাকে। কয়েক পা সামনে এগোনোর চেষ্টা করলেন তখনো। যেদিকে উদ্যত বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু ততক্ষণে জীবন নিঃশেষিত হয়ে আসছিল তার।

আবু সাঈদরা এ পৃথিবীতে একা নন। আমরা আবু সাঈদকে দেখেছি তিউনিসিয়ায় রাস্তায়, ভিয়েতনামের সায়গনে, চীনের তিয়েনানমেন স্কয়ারে। তারেক আল-তায়েব মোহামেদ বুয়াজিজিকে আমরা অনেকেই চিনি। তিউনিসিয়ার এই তরুণ নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকট আর পুলিশি অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে নিজের শরীরেই আগুন জ্বালিয়ে দেন। তার শরীরের সেই আগুনের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। স্নাতক পাস করে বুয়াজিজি কোনো চাকরি না পেয়ে স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সকাল বেলায় তিউনিসিয়ার শহর সিদি বাওজিদে ফল বিক্রি করছিলেন বুয়াজিজি। পৌরসভার নারী পুলিশ ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি বেধে যায় ঘুষের জন্য। একপর্যায়ে ইন্সপেক্টর বুয়াজিজির সব পণ্য ঠেলাগাড়িসহ আটক করে নিয়ে যায়। বুয়াজিজি অনেক কাতর অনুনয়-বিনয় করেন তার পণ্যসহ গাড়ি ফেরত পাওয়ার জন্য; কিন্তু তাতে মন গলেনি নগর কর্তৃপক্ষের। শেষমেশ মরিয়া বুয়াজিজি বাজার থেকে জ্বালানি কিনে এনে সরকারি ভবনের গেটের সামনে নিজেকে জ্বালিয়ে দেন। ১৮ দিন ধরে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৪ জানুয়ারি মারা যান মোহাম্মদ বুয়াজিজি। তার মৃত্যুর খবরে নতুন করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তিউনিসিয়ার তরুণ বিপ্লবীরা। মোহাম্মাদ বুয়াজিজির আত্মাহুতির পর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। পতন ঘটে ২৩ বছরের স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বিন আলির। বিন আলির পতনকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা ও আরবজুড়ে ওঠে গণবিপ্লবের এক ভয়াবহ ঝড়, যা ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। এই আরব বসন্তের প্রভাবে তছনছ হয়ে যায় তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, জর্ডান, লিবিয়া, কুয়েত, ওমান, ইরাক, ইরান ও ইয়েমেন।

আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের মসনদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, বুয়াজিজির আত্মহত্যা তিউনিসিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা ও আরবজুড়ে উঠেছিল গণবিপ্লবের এক ভয়াবহ ঝড়। তেমনি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ভিয়েতকং গেরিলা গ্রুপের সন্দেহভাজন নেতা নুয়েন ভ্যান লেম হত্যাকাণ্ড ভিয়েতনাম যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।

১৯৬৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সায়গনের একটি রাস্তায় লেম হত্যাকাণ্ডের ছবিটি তুলেছিলেন এপির ফটোসাংবাদিক এডি অ্যাডামস। উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী এবং ভিয়েতকং গেরিলারা ‘টেট অফেন্সিভ’ শুরুর দুদিন পরের ঘটনা এটি। ছবিতে যাকে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুলিশপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুয়েন নক লোয়ান। আর যাকে গুলি করা হচ্ছে তিনি ভিয়েতকং গেরিলা গ্রুপের সন্দেহভাজন নেতা নুয়েন ভ্যান লেম। লেম হত্যার কয়েকদিন পর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লোয়ান মেশিনগানের গুলিতে গুরুতর আহত হন এবং তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। যুদ্ধের পর তিনি যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই অপমানিত হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার একটি হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিগেডিয়ার লোয়ান যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি ভার্জিনিয়ার রোলিং ভ্যালি মলে, ‘লেস ট্রয়েস কন্টিনেন্টস’ নামে একটি পিৎজার রেস্তোরাঁ খোলেন। কিন্তু অতীত তার পিছু ছাড়েনি। তার বিগত দিনের ইতিহাস জানাজানি হওয়ার পর রেস্টুরেন্ট ব্যবসা মার খায়। ওই রেস্তোরাঁয় কেউ খেতে যেতেন না। অনেকে ওই রেস্তোরাঁর টয়লেটে ব্রিগেডিয়ার লোয়ানের বিরুদ্ধে আজেবাজে কথা লিখে আসতেন। ফটোসাংবাদিক এডি অ্যাডামস বলেছেন, ‘লোয়ানের রেস্তোরাঁর টয়লেটের দেয়ালে লেখা ছিল—We know who you are, you fucker.’ আশির দশকের শেষদিকে লোয়ান ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় রোগ ভোগের পর ১৯৯৮ সালের ১৪ জুলাই ৬৭ বছর বয়সে ভার্জিনিয়ার বার্কে মারা যান।

বিগত আশির দশকের শেষদিকে গণতন্ত্রের দাবিতে চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে একটি ছবি আজও সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করছে। ছবিটি ‘দ্য ট্যাঙ্কম্যান’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিতি।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ট্যাঙ্ক বহরের গতিরোধ করতে এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। তার গায়ে সাদা শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট। হাতে ঝোলানো দুটি শপিং ব্যাগ। যেন বাজার থেকে ফিরছেন। সময়ের প্রয়োজনে এই অতিসাধারণ মানুষটিই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়ান ট্যাঙ্ক বহরের সামনে। থামিয়ে দেন ট্যাঙ্কের গর্জন। তিনি একাই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন চীনের তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে।

আবু সাঈদ জীবন দিয়ে শেখ হাসিনার দুঃশাসন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছেন। তার লড়াই একজন, দুজন, দশজন কিংবা একশজন লুটেরার বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ ব্যবস্থার অবসান চেয়েছেন তিনি, অবসান চেয়েছেন সেই অমানবিক ব্যবস্থার, যা ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয় এবং তাদের রক্ষা করে, যা নির্দয়ভাবে শোষণ করে, নির্যাতন করে, মানুষকে সর্বস্বান্ত করে। আবু সাঈদ অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই জানতেন যে, ফ্যাসিবাদের পেছনে থাকে আঞ্চলিক পরাশক্তি, ফলে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তা কোনো বিচারেই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, সেইসঙ্গে এ যুদ্ধ অবশ্যই আধিপত্যবাদবিরোধী। অর্থাৎ আবু সাঈদ শুধু বিষবৃক্ষের পতন চাননি, চেয়েছেন ভূমির আমূল সংস্কার। আমরা যদি সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারি, তবেই আবু সাঈদের প্রতি প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধা জানানো হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বগুড়ায় বিএনপি নেত্রীকে হত্যার হুমকি

পুরুষ কর্মীদের জন্য সুখবর, নিয়োগ দিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ

১৭ জুলাই: আজকের রাশিফলে কী আছে জেনে নিন

আজ সারা দেশে এনসিপির বিক্ষোভ কর্মসূচি

থমথমে গোপালগঞ্জ

ফিরে দেখা ১৭ জুলাই / গায়েবানা জানাজায় পুলিশের বাধা, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

আজ দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে

বিয়ে করছেন সেলেনা গোমেজ

আলাস্কায় ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা

স্টোর ইনচার্জ পদে নিয়োগ দিচ্ছে সিএসআরএম

১০

পশুপ্রেম থেকে পরিশুদ্ধ জীবনে মিমি চক্রবর্তী

১১

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নিচ্ছে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস

১২

পাহাড়ের মাটিতে রাম্বুটান, সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

১৩

‘জুলাই বিপ্লবের এক বছরেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের দমন করা যায়নি’

১৪

বাড়ি বিক্রি করলেন সালমান খান

১৫

আবেদন খারিজ / নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে মামলা বহাল

১৬

রাজনীতিতে শিষ্টাচার শুধু বিএনপির মধ্যেই আছে : আমিনুল হক

১৭

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৮

সিরিয়ায় হামলা / ইসরায়েলকে থামতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র

১৯

প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ গাছের চারা

২০
X