আহমেদ ভেফা রেন্দে
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিরিয়ায় ইসরায়েলের দ্রুজ নীতি

সিরিয়ায় ইসরায়েলের দ্রুজ নীতি

আয়তন ও জনসংখ্যায় ইসরায়েল বেশ ছোট একটি রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্বের মিত্র রাষ্ট্র হলেও দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল। তার অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার পেছনে যত কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো দেশের ভেতর বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপস্থিতি। এর মধ্যে আরবরা সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হওয়ায় ইসরায়েল অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বহু আগে থেকেই তাদের সঙ্গে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার নীতি চর্চা করে আসছে ইসরায়েলি সরকার। এ প্রেক্ষাপটে দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক, তাদের ইহুদি সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস এবং এ সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কৌশল বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে।

ইসরায়েলে অবস্থানরত দ্রুজ সম্প্রদায়ের প্রায় দেড় লাখ মানুষ। প্রধানত কারমেল, গালিলি এবং গোলান অঞ্চলজুড়ে বসবাস করে তারা। বস্তুত একাদশ শতকের মিশরে এ ধর্মীয় সম্প্রদায়টির উদ্ভব ঘটে। ইসলাম, ইহুদি ধর্ম ও খ্রিষ্টধর্ম—তিনটির সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ধর্ম এটি। শিয়া মুসলিমদের ইসমায়েলি শাখা থেকে উৎপত্তি ঘটেছে এ সম্প্রদায়ের। দ্রুজরা অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় না দেখে তাদের সামাজিক গঠন অত্যন্ত দৃঢ় বন্ধনযুক্ত এবং সম্প্রদায়টি বেশ আত্মনিবিষ্ট বলে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষের সঠিক সংখ্যাটা জানা যায় না, কিন্তু তাদের সিংহভাগই আজ ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করছে।

ওসমানীয় সাম্রাজ্য ফিলিস্তিন অঞ্চল ত্যাগ করার পর, জায়নিস্ট নেতারা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় দ্রুজদের সমর্থন লাভের লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। দ্রুজরা আরবীয় সম্প্রদায় হলেও, ইসরায়েলের সরকার তাদের আরবদের থেকে ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র একটি গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে এবং ইহুদিদের সঙ্গে ধর্মীয় সম্পৃক্ততার কথা বলে এ সংখ্যালঘুর সমর্থন অর্জনের প্রয়াস চালায়। ১৯৩০-এর দশকের শেষদিকে ইসরায়েলের ইহুদি ও দ্রুজদের মধ্যে একটি আধাসামরিক জোট গঠিত হয়। কিন্তু সেই জোট সমগ্র দ্রুজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত না। কারণ, ওই সময়ে দ্রুজদের বড় একটি অংশ ১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া আরব বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে।

রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই আরবদের বাদ দিয়ে অন্যান্য ছোট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট ছিল ইসরায়েলের সরকার। দ্রুজ সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি ও কিছু বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে তাদের আরব সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করার কৌশল গ্রহণ করে তারা। ১৯৬২ সালে দ্রুজদের একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং আরব পরিচয় থেকে তাদের পৃথক করা হয়। এর ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ইহুদি সমাজে দ্রুজদের একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সম্প্রদায় হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব হয়।

এ ছাড়া ১৯৭৬ সালে দ্রুজ সংস্কৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি পৃথক শিক্ষা বিভাগ গঠন করা হয় এবং এ সম্প্রদায়ের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার আইন জারি করা হয়। এই নীতি কেবল ফিলিস্তিনি দ্রুজদের ক্ষেত্রেই নয়, ইসরায়েল গোলান উপত্যকা দখলের পর সিরিয়ান দ্রুজদের জন্যও এ আইন জারি করে। গোলান দখলের সময় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে ইসরায়েলি বাহিনী। কিন্তু ৬ হাজার ৩৯৬ জনকে সেই অঞ্চলটিতে থাকতে দেওয়া হয়, কারণ তারা সবাই ছিল দ্রুজ সম্প্রদায়ের। তাদের আরব পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাওয়ার একটা অংশ হিসেবে এরকম বিভিন্ন ‘শিথিল’ নীতি প্রয়োগ করে ইসরায়েল। তবে সিরিয়ান দ্রুজরা এ নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়নি। সিরিয়ার সরকারকে অপছন্দ করলেও তারা নিজেদের সিরিয়ার অংশ হিসেবেই দেখতে বেশি আগ্রহী। ভবিষ্যতে সিরিয়ার সঙ্গে ফের সংযুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা।

ইসরায়েলে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। সেনাবাহিনী একদিকে যেমন ইসরায়েলে বসবাসরত ইহুদিদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক মজবুত করে, অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মানুষের প্রতিও সমাজে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্রুজ সম্প্রদায়কে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়া হয়েছে ইহুদি সমাজের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও সংহত করার উদ্দেশ্যে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর, বহু দ্রুজ সৈন্য গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে অংশ নেয়। হামাসের হামলায় ৪৩০ জনের বেশি দ্রুজ নিহত হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল যে কৌশলগতভাবে দ্রুজদের আরবদের থেকে পৃথক করে ইহুদি সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছে, তাতে অনেক দ্রুজ নেতাও সাড়া দিয়েছেন। তারা সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অর্জনের আশা করছিলেন। এর মাধ্যমে তারা দ্রুজ গ্রামগুলোয় অবকাঠামোগত বিনিয়োগের অভাব, কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের মতো কাঠামোগত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন।

তবে বাস্তবে দ্রুজরা এখনো ইহুদি সমাজে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সেনাবাহিনীতে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর দ্রুজদের অনেকেই ইহুদি সমাজে আবারও বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। ইসরায়েলি সংসদ সদস্য সাঈদ নাফা বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম যে, সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করার মাধ্যমে আমরা অন্য ইসরায়েলিদের মতো সমান অধিকার পাব। কিন্তু আমরা এখন বুঝতে পারছি যে, এটা ছিল একটা বিভ্রম মাত্র।’ এ কারণে আজকের দিনে অনেক দ্রুজ যুবক সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে সমান অধিকার পেলেও, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে বলে দাবি করেছে তারা। এ ছাড়া দ্রুজ সম্প্রদায়ের যারা ইহুদি এলাকায় বসবাস করতে চায়, তাদের একই বাড়ির জন্য বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। অন্যান্য কিছু রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জটিলতার শিকার হতে হচ্ছে তাদের।

এ বৈষম্যগুলো আপাতত ইসরায়েলে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি না করলেও, রাষ্ট্র যদি তার নীতি পরিবর্তন না করে, তাহলে দ্রুজদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে তারা নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ উদ্বেগ প্রশমিত করতে ইসরায়েল সম্প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যার খরচ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। উত্তর ইসরায়েলে বসবাসকারী দ্রুজদের আবাসন সমস্যার সমাধান করা এর প্রধান লক্ষ্য।

ইসরায়েলের সরকার গোলান উপত্যকা দখলের সময় যেমন দ্রুজদের ব্যবহার করেছিল, ঠিক একইভাবে এখন তারা সিরিয়ার দ্রুজ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। একদিকে ইসরায়েল সিরিয়ার নতুন সরকারের বিরুদ্ধে দ্রুজদের উসকে দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সমর্থন আদায়ের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সম্প্রতি ঘোষণা দেন যে, সিরিয়ান দ্রুজদের শিগগির ইসরায়েলে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। দামাস্কাসের সেরমানা নামক দ্রুজ পাড়ায় সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেখানে দ্রুজদের রক্ষা করতে সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্রুজ নেতারা সে প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। দ্রুজদের প্রতি সমর্থন দেখানোর উদ্দেশ্যে সুয়েইদা অঞ্চলে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের দরুন ইসরায়েল সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।

ফিলিস্তিনের দ্রুজদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই সিরিয়ার দ্রুজদেরও কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করতে চাচ্ছে ইসরায়েলি সরকার। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী। তাই সেখানে দ্রুজ সংকটকে কাজে লাগিয়ে অঞ্চলটিকে আরও অস্থির করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এ পরিকল্পনা সফল হলে ভবিষ্যতে সেই অঞ্চল দখলে নেওয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। দ্রুজ জনগোষ্ঠী যদি ইসরায়েলের অস্ত্রে পরিণত হয়, তবে তারা নিজেরাই ভবিষ্যতে নিজেদের অধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক: তুরস্কের সাকর্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক।

নিবন্ধটি মিডল ইস্ট মনিটরের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

১০

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

১১

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১২

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১৩

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১৪

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৫

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৬

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৭

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৮

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৯

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

২০
X