দেশের সাড়ে তিন কোটির অধিক শিশু সিসার ক্ষতিকর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। কোনো সন্দেহ নেই যে, এই সংবাদ গভীর উদ্বেগ ও হতাশার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই ভীতিকর চিত্র লক্ষ করা যায়। দেখা যায়, দেশের ৩৬ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু সিসার এই ক্ষতিকর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। যার মধ্যে পাঁচ বছরের কমবয়সী অন্তত দুই কোটি শিশু সিসার ক্ষতিকর প্রভাবে বেড়ে উঠেছে দুর্বল মেধা নিয়ে। এমনকি দেশে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যে প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, তার পেছনেও রয়েছে সিসার পরোক্ষ ভূমিকা। বুধবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সিসা দূষণ প্রতিরোধ: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য উঠে আসে। এ সময় আরও জানানো হয়, সিসা বিষাক্ত ভারী ধাতু। এটি নীরবে লাখ লাখ মানুষের, বিশেষ করে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে। রক্তের মধ্যে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) শিশুদের রক্তে প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসার উপস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করে। সেখানে বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এর গড় পরিমাণ ৬৮ মাইক্রোগ্রাম। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে সিসা দূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানে চতুর্থ।
আলোচনায় উঠে আসে, সিসা দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সিসা ও ব্যাটারি-সম্পর্কিত শিল্পকারখানা, সিসাযুক্ত রং এবং প্রসাধনী ও রান্নার পাত্রের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বিশেষ করে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পের আশপাশের শিশুরা এর সবচেয়ে বড় শিকার। সিসানির্ভর শিল্প স্থাপনার ১ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা ৫ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। অন্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরের ভেতরে ধূমপান, দূষিত ধূলিকণা, সিসাযুক্ত প্রসাধনসামগ্রী ও রান্নার পাত্র। মানুষ নিঃশ্বাসে যে বাতাস নেয়, যে খাবার খায়, দূষিত মাটি বা ধূলিকণা স্পর্শ করে এবং এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের প্লাসেন্টা (গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া একটি বিশেষ অঙ্গ, যা মা ও ভ্রূণের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে) থেকেও সিসা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। ক্ষতিকর এ সিসার ফল অত্যন্ত ভয়ংকর। এটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতার প্রধান কারণ। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। কমে যায় বুদ্ধিমত্তা ও শেখার ক্ষমতা; যা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বিষাক্ত ভারী এ ধাতু নীরবে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষতি করে চলেছে স্বাস্থ্যের।
আমরা মনে করি, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের অধিক শিশু। বিরাটসংখ্যক এসব শিশুর শরীরে উদ্বেগজনক মাত্রার ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতিকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া কিংবা উদাসীনতা দেখানোর সুযোগ নেই। বরং এটাকে তীব্র জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে ভাবাই শ্রেয়। কেননা আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন একটি ভীতিকর স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বড় হচ্ছে, অর্থাৎ এ বিষক্রিয়া নীরবে কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা; যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পুরো জাতির ওপর। এ ক্ষেত্রে বন্ধ করতে হবে সিসা নিঃসরণকারী ক্ষতিকর উৎসগুলো, যেমন—সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি বানানো বা রিসাইক্লিংয়ের স্থাপনা এবং যেসব কারখানা বা স্থাপনায় সিসা গলানো বা পোড়ানো হয়, এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি দরকার জনসচেতনতা। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার ও সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
মন্তব্য করুন