মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১১ ভাদ্র ১৪৩২
রেজাউল করিম ফকির
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অবক্ষয়ে উচ্চশিক্ষা

অবক্ষয়ে উচ্চশিক্ষা

একটি জাতির শিক্ষাব্যবস্থা শুধু দক্ষ কর্মী তৈরির মেশিন নয়—এটি তার সভ্যতা, মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যতের নৈতিক মানচিত্র নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু যখন সেই শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় পাপবোধ, নীতিবোধ, বিবেকবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ—এ মৌলিক নৈতিক অনুষঙ্গগুলোর অবক্ষয় ঘটে, তখন তা একটি জাতির জন্য বিপর্যয়ের সমতুল্য হয়ে ওঠে।

আজকের দিনে এ অবক্ষয়ের বহুমাত্রিক রূপ আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ভয়ানক রূপে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। নিয়মানুবর্তিতা, পেশাগত সততা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির যে শিক্ষা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক দাবি ছিল, তা আজ ক্ষমতা, লোভ, সুবিধাবাদিতা ও এক ধরনের আত্মম্ভরিতার কাছে পরাজিত।

নৈতিক বোধের অবক্ষয় ও তার প্রতিফলন: আজ আমরা দেখছি, সমাজের তথাকথিত ‘অভিজাত শ্রেণি’ যখন নিয়মভঙ্গ করে, প্রতারণা করে, সচ্ছলতা বা ক্ষমতার জোরে মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে, তখন সাধারণ মানুষের চোখেও সেই অনিয়মগুলো আর অনিয়ম মনে হয় না। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যই যখন মানসচক্ষুতে অস্পষ্ট হয়ে যায়, তখন অবক্ষয় শুধু শিক্ষাব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ থাকে না; তা সমাজের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পদোন্নতি কিংবা সম্মানজনক পদ পাওয়ার যে প্রক্রিয়া, সেখানে তো থাকা উচিত ছিল কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, স্বচ্ছতা ও মেধাভিত্তিক যাচাই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেই পরীক্ষাগুলো রূপ নিচ্ছে নিছক আনুষ্ঠানিকতার, কিংবা আরও খারাপভাবে—পাশ কাটানোর প্রাতিষ্ঠানিক পথ তৈরি হচ্ছে।

‘পরীক্ষা’ নামক প্রতিষ্ঠানটির বিপর্যয়: প্রভাষক থেকে অধ্যাপক হওয়ার জন্য যে পেশাগত উৎকর্ষতা ও একাডেমিক মাপকাঠি থাকা উচিত—বিশেষ করে গবেষণা, সন্দর্ভ রচনা, স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশনা ইত্যাদি, সেগুলোকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে অনেকেই পদোন্নতি পাচ্ছেন। এটি শুধু নিয়ম ভাঙা নয়, বরং এক ধরনের নৈতিক প্রতারণা, যেখানে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সুবিধাবাদে পুরো পেশাটির মর্যাদা ধ্বংস হচ্ছে।

গবেষণা প্রকাশনার ক্ষেত্রে যখন ‘ghost-writing’, ‘plagiarism’, অথবা ‘অন্যের লেখা নিজের নামে চালানো’র মতো অনৈতিক পথ গ্রহণ করা হয়, তখন সেটি একক কোনো ব্যক্তির অবক্ষয় নয়; সেটি পুরো শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা ও দায়হীনতার বহিঃপ্রকাশ।

অবৈধ উপায়ে অধ্যাপক এবং তার পরিণতি: সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো, যারা এই নিয়মভঙ্গ করে অধ্যাপক পদে আসীন হন, অনেক ক্ষেত্রে তারাই আবার জাতীয়ভাবে স্বীকৃত ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হওয়ার সম্মান পান। তখন প্রশ্ন ওঠে—এই ‘জাতীয়তা’র ভিত্তি কী? যদি এই ব্যক্তি জীবনে একটিও পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক পরীক্ষা পাস না করে থাকেন, তবে কীভাবে তিনি জাতির জন্য আদর্শ হবেন?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, এসব ‘জাতীয় অধ্যাপক’ আসলে একেকটি নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পাথর, যার নিচে জাতির আত্মা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে আছে। তারা প্রতীক হয়ে ওঠেন নিয়মভঙ্গ, সুবিধাবাদিতা ও প্রতারণার প্রতিষ্ঠানে। ফলত, শিক্ষার্থী, নতুন গবেষক বা তরুণ প্রজন্ম তাদের দেখে প্রেরণা না পেয়ে হতাশ হয়—বিশ্বাস হারায় নিয়ম, অধ্যবসায় ও সততার প্রতি।

অবক্ষয়ের ফলাফল

যোগ্যতা ও মেধার অবমূল্যায়ন: যারা কঠোর পরিশ্রম করে প্রকৃত গবেষণা করেন, তারা পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়েন। ফলে মেধার প্রতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক অবজ্ঞা তৈরি হয়।

চাটুকারিতা ও নেটওয়ার্কিংয়ের প্রতিযোগিতা: সৎ ও মেধাবী গবেষকের পরিবর্তে ‘চতুর’ ও ‘রাজনৈতিকভাবে সুবিধাবাদী’ ব্যক্তিরা এগিয়ে যায়।

ছাত্রদের অনুপ্রেরণার অভাব: শিক্ষক যদি নিজের কৃতিত্বে না আসীন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের চোখে সেই শিক্ষকের কথার গুরুত্ব থাকে না।

সমাজে জ্ঞানের মূল্যহ্রাস: যখন সমাজ জানে ‘অধ্যাপক’ কিংবা ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হয়েও কেউ পরীক্ষা পাস করেননি, তখন গোটা বিদ্যা ও গবেষণার পরিমণ্ডলই হাস্যকর হয়ে ওঠে।

উত্তরণের পথ

সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা: প্রমোশন বা পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।

প্লাগিয়ারিজম ও গবেষণার মান নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা: গবেষণা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে।

নৈতিক শিক্ষা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শুধু বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা নয়, বরং নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও শিক্ষকতার অপরিহার্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কার: এ মর্যাদাপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা ও যাচাই-পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

অবক্ষয় কখনো হঠাৎ করে আসে না। এটি ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরকার বোধগুলোকে ক্ষয়ে যায়—প্রথমে পাপবোধ, তারপর নীতিবোধ, তারপর বিবেকবোধ। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এ অবক্ষয়ের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলনস্থল, কারণ এখানে জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল মেধাগুলোর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ ঘটে। এ ব্যবস্থায় যখন অযোগ্য, অদক্ষ, অনৈতিক ব্যক্তি অধ্যাপক হন, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত নয়; জাতিগত আত্ম-অস্বীকৃতির দলিল হয়ে ওঠে।

এ অবক্ষয়ের নিচে চাপা পড়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা ও আত্মবিশ্বাস দুটোই মাটিচাপা পড়া। সুতরাং, এ চক্র ভাঙতে হলে নৈতিকতার আলোকে এবং নীতিনিষ্ঠতার পথে সাহসী সংস্কার অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাব্বিরকে পাঁচ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ বিসিবির আকুর

জিয়ার সমাধিতে ডা. সাবরিনার শ্রদ্ধা, যুবদল সভাপতির ক্ষোভ

শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিতর্ক, অর্থপাচার বিরোধী অভিযানে চাপ

অভিনেত্রী জাহানারা ভূঁইয়া মারা গেছেন

ঢাকা শিশু হাসপাতাল শাখা ড্যাবের নতুন দায়িত্বে ডা. ফারুক

এনসিপির আরও চার নেতার পদত্যাগ 

হাইকোর্টের বিচারপতি হলেন সারজিসের শ্বশুর লুৎফর রহমান

ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণার বিধিমালা প্রকাশ

হাসনাতকে ‌‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বললেন রুমিন ফারহানা

বিজিবির কাছে ৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ

১০

চুরির অভিযোগ, গণপিটুনিতে যুবক নিহত

১১

সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি : ড. কামাল হোসেন

১২

রাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকারের দাবিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৩

চট্টগ্রামের মিষ্টি কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, মধুবন ফুডকে জরিমানা

১৪

আশুলিয়ায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

১৫

জাবির সাবেক সহকারী প্রক্টর জনি রিমান্ডে

১৬

প্রাণনাশের শঙ্কায় ভুগছেন ফজলুর রহমান, চাইলেন নিরাপত্তা

১৭

বাংলাদেশ সফর নিয়ে ইসহাক দারের প্রতিক্রিয়া

১৮

অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে চিকিৎসার মান কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছায়নি : ডা. রফিক 

১৯

মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানো থালাপতির উত্থানের গল্প

২০
X