ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর একে একে বেরিয়ে আসছে তার দুর্নীতি, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের চিত্র। মানুষ যা অনুমান করেছিল, তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এ দেশের মানুষ। আয়নাঘরের নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনো অনেকে শিউরে ওঠেন। শেখ হাসিনার আয়নাঘর ছিল কবরের মতো সংকীর্ণ।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি তাদের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরোট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান এ কথা জানিয়েছেন। চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দিতে বলেছেন, রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে আনা গুরুতর আহত ১৬৭ জনের বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না। ১৮ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। রোগীদের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে, মুখে, গলায় গুলি ও পিলেটবিদ্ধ (ছররা গুলি) ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় আকৃতির। ৪-৫ আগস্ট যেসব রোগী আসে, তাদের অধিকাংশের মাথায়, বুকে, মুখে, গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড পাঠানো হয়। সাক্ষী মাহফুজুর রহমান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। এদিন আরও তিনজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। এ পর্যন্ত ১৬ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন। জবানবন্দিতে চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান আরও বলেছেন, ৩৩টি অস্ত্রোপচার তার নেতৃত্বে হয়েছে। ১৫টির মতো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছেন। কিছু বুলেট বের করা যায়নি। অনেক গুলি ও পেলিট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়। গত বছর ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য তাকে চাপ দেন। ডিবির সদস্যরা বলেছিলেন, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের (গুলিবিদ্ধদের) বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন কৌশলে ভর্তি রেজিস্টারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাকসিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করা হয়। এরকম অমানবিক ঘটনার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছে, তাদের বিচার ও প্রকাশ্যে ফাঁসি চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য ও জেরা শেষ করেন এ চিকিৎসক।
আমাদের প্রত্যাশা, আইনের আওতায় গ্রহণযোগ্য বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সেইসঙ্গে দেশে আর যাতে কোনোদিন ফ্যাসিবাদের উত্থান না হতে পারে, এ ব্যাপারে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
মন্তব্য করুন