ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

অমোঘ নিয়তির মুখোমুখি বাতিঘর

অমোঘ নিয়তির মুখোমুখি বাতিঘর

মানুষ মাত্রই মরণশীল। রাজাধিরাজ থেকে পথের ভিখিরি কেউই মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারেন না। জীবনকে মহিমান্বিত করে গড়ে তুলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কোথা কে কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে জীবন-নদে’—কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কালজয়ী কবিতার এ পঙ্ক্তিতে সেই আর্তনাদই প্রকাশ পেয়েছে। এই অমোঘ সত্য জেনেও মানুষ বাঁচতে চায়। সুন্দর পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করতে চায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। কোটি কোটি বছরের পুরোনো পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের মৃত্যুই আলাদা আলাদা নতুন অনুভূতি তৈরি করে। মানবজীবনের এ অনিবার্যতা মেনে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’। এর মাধ্যমে কবি মৃত্যুকে জীবনেরই একটি অংশ হিসেবে দেখেছেন। তিনি মৃত্যুকে সরাসরি আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। কবি মনে করেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনকে সম্পূর্ণভাবে জানা যায়। কবির এ অনুভূতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের হয়তো দ্বিমত নেই। কিন্তু, বেঁচে থাকার জন্য মানুষ লড়াই করে মৃত্যু পর্যন্ত। প্রিয়জন সহজে মেনে নিতে পারে না স্বজন বিয়োগ। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সান্ত্বনা দিয়ে লিখেছেন, ‘এমন জীবন তুমি করিও গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন’। এরকম এক জীবন নিয়েই মৃত্যুর সঙ্গে বর্তমানে লড়ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলীয় নেত্রী থেকে তিনি এখন সার্বজনীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। দল-মত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর রোগমুক্তি চেয়ে প্রার্থনা করছেন।

রাজনীতির মত-দ্বিমত-সংকীর্ণতা ভুলে সবাই খালেদা জিয়াকে সুস্থ দেখতে চায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তি, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষ কায়মনোবাক্যে দোয়া করছেন সবাই। এ এক অনির্বচনীয়, অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। বাংলাদেশে এর আগে কখনো একজন রাজনীতিবিদের জন্য এরকম গণউৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। দেশের সীমা ছাড়িয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আজীবন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী এ নেত্রীকে অনেক আগেই ভালোবেসে মানুষ—দেশনেত্রী, গণতন্ত্র ও মানবতার মা, সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী বিশেষণে সম্বোধন করে আসছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ও ত্যাগী ভূমিকার জন্য আপসহীন নেত্রী উপাধি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী সব পরিচয়েই আলো ছড়িয়েছেন তিনি। স্বল্পবাক, মিষ্টভাষী খালেদা জিয়া অভিজাত ব্যক্তিত্ব দিয়ে বছরের পর বছর দেশবাসীকে মুগ্ধ করে রেখেছেন। তাকে অনেকেই সৌভাগ্যবতী মনে করেন। কিন্তু তার এ অর্জন শুধু ভাগ্যজোরে নয়। ভাগ্যের সাহসী ও পরিশ্রমী ব্যবহারে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। রাজনীতির কণ্টকিত পথে তিনি এক স্মিত গোলাপ। তার সুবাস ও সুভাষে ঝানু রাজনীতিবিদরা তাকে সম্মান জানাতে বাধ্য হয়েছেন।

৫৪ বছরের বাংলাদেশের রাজনীতির ৪৩ বছর তার দখলে। টানা চার দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন তিনি। এই দীর্ঘ যাত্রাপথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তার জন্য। নির্ভীক, সৎ সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে সাংসারিক জীবন শুরু করেন কৈশোরে। নিজের বিবাহিত জীবনের সোনালি সময়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র বাসনায় পরিবার ফেলে যুদ্ধের ঘোষণা দেন মেজর জিয়া। অরক্ষিত বেগম জিয়া শিশু তারেক রহমানসহ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশেও হয়রানির শিকার হয় জিয়া পরিবার। পদোন্নতিবঞ্চিত, উদ্দেশ্যমূলক বদলি ও বৈষম্যের শিকার হন জেনারেল জিয়া। ক্যু-পাল্টা ক্যুর টালমাটাল সেনাজীবনে বারবার ঝুঁকিতে পড়েন জিয়াউর রহমান। অশান্ত সে সময়ে দুটি শিশুসন্তান নিয়ে ভুক্তভোগী নিরীহ গৃহবধূ খালেদা জিয়া। সেনাপ্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও মধ্যবিত্ত জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। জিয়ার রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে তিনি ছিলেন যোজন যোজন দূরে। দুই ছেলে নিয়ে শান্ত গৃহবধূর জীবন ছিল তার। কাজপাগল জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্য ছিল পারিবারিক উৎসব ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ। সেই শান্ত জীবনে আকাশ ভেঙে পড়ে জিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। সারা দেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায় ক্ষণজন্মা জিয়াকে হারিয়ে। শোক সাগরে ভাসতে থাকেন খালেদা জিয়া। ছেলেদের ও নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার সুযোগও পান না দেশ-জাতির আহ্বানে। স্বামীর গড়া দল বিএনপির হাল ধরতে হয় তাকে। জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় দল ও সরকারে পরিবারের কাউকে উৎসাহিত করতেন না। অথচ, তার অবর্তমানে রাজনীতিতে সবচেয়ে অনভিজ্ঞ মানুষটিকেই যুক্ত হতে হয়। কী আশ্চর্য সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী খালেদা জিয়া! কালক্রমে বংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন তিনি।

পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে পর্যায়ক্রমে দলের প্রধান হন খালেদা জিয়া। ঝানু রাজনীতিবিদ ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই নিজের অবস্থান দৃঢ় করেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছ থেকে দলের একক কর্তৃত্ব পেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম শিক্ষিত বলে সবসময় তাকে নিয়ে নিষ্ঠুর সমালোচনা করেছে প্রতিপক্ষ। কিন্তু স্বশিক্ষিত খালেদা জিয়া তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতদের অনেক শিখিয়েছেন। দেশপ্রেম, উদারতা, রুচি ও শালীনতাবোধ, ধৈর্য এবং মানবিকতা দিয়ে তিনি জয় করেছেন সবকিছু। নির্বাচনে কোনো দিন কোনো আসনে পরাজিত হননি তিনি। রাষ্ট্র পরিচালনায় বিস্ময়কর মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পরিমিতবোধ ও যোগ্যদের মুল্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে অনিবার্য করে তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দেশের উন্নয়ন ও নারী শিক্ষায় বিরাট অবদান রেখেছেন। আবার, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীরা বারবার তার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। শত্রুরাও তাকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে খালেদা জিয়া লাখ লাখ ভক্ত-অনুসারী পেয়েছেন। এজন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। প্রতিপক্ষ তার রাজনৈতিক ক্যারিশমার সামনে টিকতে না পেরে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছে। পলাতক নেত্রী শেখ হাসিনা সারা জীবন তাকে উদ্দেশ্য করে একতরফাভাবে মেয়েলি ঝগড়া করেছেন। তার বিপরীতে বেগম জিয়া নীরব থেকে জনমন জয় করেছেন। গত ফ্যাসিস্ট জামানায় মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে। সুচিকিৎসা বঞ্চিত করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলে তারেক রহমানকে নির্বাসনে পাঠায় এক/এগারোর ষড়যন্ত্রী সরকার। আর ছোট ছেলে আরাফাত রহমানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় হাসিনা সরকার। তারপরও দমে যাননি তিনি। দেশ ও মানুষকে ছেড়ে যাননি কখনো। সুযোগ থাকার পরও বিদেশের নিশ্চিন্ত বিলাসী জীবন তাকে টানেনি। জিয়া পরিবার ধ্বংসে উঠেপড়ে লাগে আওয়ামী লীগ সরকার। এমনকি শহীদ জিয়ার কবর সরিয়ে ফেলার মতো ঘৃণ্য উদ্যোগও নিয়েছিল তারা। কোনো কিছুতেই টলাতে পারেনি মজলুম নেত্রী খালেদা জিয়াকে। শত অত্যাচারে আরও সংগঠিত হয়েছে তার দল তথা পুরো জাতি। তিনিই এখন জাতির বাতিঘর। সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের অনন্য প্রতীক এ লৌহমানবী।

বাপের দেশ দাবি করেও শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে পালাতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের আবদার মিটিয়েও শেষরক্ষা হয়নি তার। এখন পরদেশে আশ্রিতা তিনি। আর এদিকে, মৃত্যুপথযাত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার সুস্থতা কামনায় সারা দেশ এখন এক কাতারে। জাতির অভিভাবক হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সব দল, সব মানুষ। এমনকি, সাধারণ আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও তার জন্য দোয়া করছেন। এক আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুদ্ধিজীবী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বিচিত্র জীবন! বিচিত্র ইতিহাস! / জেনারেল জিয়ার শেষ বিদায় হয়েছিল লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। কফিনে তাঁর মরদেহ ছিল কি-না তা নিয়ে এখনো বিতর্ক। খালেদা জিয়াকেও বিদায় জানাবে লাখো মানুষ। যার ডাকে যার পেছনে জীবন দিতে এগিয়েছিল লাখো মানুষ সেই বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়েছিল প্রায় অজ্ঞাত স্থানে, কয়েকজন সেনার সামনে। শেখ হাসিনার জানাজা কোথায় কতজনের উপস্থিতিতে? দেবা ন জানন্তি, ক্যুতো মনুষ্যা!’

কে জানে হয়তো জিয়ার কবরে খালেদা জিয়াকে সমাহিত করা হবে। তাহলে মরদেহ থাকা না থাকা নিয়ে হয়তো আর বিতর্ক থাকবে না। তবে, এখন জরুরি খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা। তারেক রহমান কেন আসছেন না? সে বিতর্কও জরুরি নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো খালেদা জিয়ার সারা জীবনের আরাধ্য সেই ‘গণতন্ত্র’ ফিরছে কি না! সেজন্য বিএনপি তথা গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষের উচিত খালেদা জিয়ার আদর্শকে ধারণ এবং লালন করা। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন, স্বনির্ভর, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লড়ছেন খালেদা জিয়া। তার সুস্থতা ও স্থিতিশীল দেশের জন্য প্রার্থনা।

লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই জিয়া পরিবারের শক্তি : তারেক রহমান 

রাতের আঁধারে অর্ধশতাধিক বনজ গাছ কেটে ফেলল দুর্বৃত্তরা

দুপুরে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা জানাবেন ডা. এ জেড এম জাহিদ 

পালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না আ.লীগ নেত্রী শাহনাজের

ভয়ংকর এই যুদ্ধবিমান বিশ্বের মাত্র একটি দেশেই আছে

আজ বায়ুদূষণে শীর্ষে নয়াদিল্লি, ঢাকার অবস্থান কত? 

স্ত্রীর জন্য নায়িকাদের সঙ্গে রোমান্স করতে ভয় পান কপিল

পুলিশের নজরে ৩ ক্রিকেটার

আখেরি মোনাজাতে শেষ হলো জোড় ইজতেমা

সিরিজ বাঁচানোর ম্যাচে যেমন হতে পারে বাংলাদেশের একাদশ

১০

আজ থেকে নতুন দামে স্বর্ণ বিক্রি শুরু, ভরি কত

১১

নতুন লুকে রণবীরকে যা বললেন দীপিকা

১২

তেঁতুলিয়ায় মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড

১৩

মৃত্যুর সঙ্গে ৯ দিন লড়েও হার মানলেন মেহেদী

১৪

আইপিএল মিনি অকশনে বাংলাদেশের দুই তারকা ক্রিকেটার

১৫

আজ কী আছে ভাগ্যে, জেনে নিন রাশিফলে

১৬

সরকারের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ কারা, তারা কী সুবিধা পান

১৭

মতলব সেতুর জয়েন্টে ফাটল, আতঙ্কে লাখো মানুষ

১৮

প্রথমবার একযোগে তিন দেশে এইচআইভির টিকাদান শুরু

১৯

দুপুর পর্যন্ত যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

২০
X