শ ম রেজাউল করিম
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংকটে-সংগ্রামে শেখ হাসিনার সঙ্গী

সংকটে-সংগ্রামে শেখ হাসিনার সঙ্গী

শেখ রেহানা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবুবের কনিষ্ঠ কন্যা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় যেখানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, সেখানেই ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন শেখ হাসিনার আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। যিনি ছোট ভাই শেখ রাসেলের ‘দেনা’ আপা। সাদামাটা আর নির্মোহ ও নিরহংকার জীবনযাপনের এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ শেখ রেহানা। জাতির পিতার কন্যা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির উত্তরসূরি আর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থেকেও ছিলেন রাজনীতির বাইরে। তবে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও রাজনীতিসচেতন শেখ রেহানা এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বড় বোন শেখ হাসিনার অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও দেশের ক্রান্তিকালে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার পাশে থেকে শক্তি জুগিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন শেখ রেহানা। যেমন করে বঙ্গবন্ধুর যে কোনো সংকটে নির্ভীক সহযাত্রী ছিলেন বঙ্গমাতা, ঠিক তেমন করেই যে কোনো সংকট আর সংগ্রামে কালক্রমে বড় বোন শেখ হাসিনার নিভৃত সঙ্গী হয়ে ওঠেন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা পরস্পরের কতটা পরিপূরক তা বোঝা যায় তাদের নিজেদের কথাতেই। শেখ রেহানা নিজে বলেছেন, ‘আমরা দুই বোন একে অন্যের পাশে আছি। দুজনকে সাহায্য করি। খুব ভালোবাসি।’ বড় বোন শেখ হাসিনাও বলেছেন, শেখ রেহানা ছাড়া তিনি পরিপূর্ণ নন। শেখ রেহানার মধ্যে তিনি তার মায়ের ছায়া দেখতে পান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার সময় শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সে সময় প্রবাসে জাতির পিতার দুই কন্যাকে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। জীবনযাপন করতে হয়েছে অত্যন্ত মানবেতরভাবে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে হয়েছে আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্যটুকুও তাদের ছিল না। শেখ রেহানা সে সময় বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনেও কর্মখালি দেখে চেষ্টা করেছেন। লন্ডনে মেট্রো ও বাসে যাতায়াত করতে হয়েছে তাকে। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে শেখ রেহানা নিজেই লিখেছেন, ‘লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এরপর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছে।’ এতটা সংকটে ভেঙে পড়লেও শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার মতোই সে সময় উঠে দাঁড়িয়েছেন, সামলে নিয়েছেন। কারণ তারা যে জাতির পিতার কন্যা। অদম্য আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা ছিলেন বলীয়ান। জাতির পিতার রক্ত যে বইছিল তাদের ধমনিতে।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যখন দেশের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সামরিক শাসক আর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এমনকি দেশের মানুষও বাংলাদেশের প্রকৃত খবর জানত না। সে সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ বা বিচার চাওয়া ছিল দুরূহ-দুঃসাধ্য। সে প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পিতা হত্যার প্রথম বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন শেখ রেহানা। ১৯৭৯ সালের ১০ মে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা খুনিদের বিচারের দাবি উত্থাপন করেন তিনি। এটি ছিল বিশ্বদরবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রথম আহ্বান। ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেদিন সর্ব-ইউরোপীয় নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে লন্ডনে অবস্থানরত শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেছিলেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও ছোট বোনকে সম্মেলনে যেতে বলেছিলেন। সেখানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছিলেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার পাঠানো বাণী পাঠ করেন তিনি। বড় বোনের পক্ষে বক্তব্যও দেন তিনি। এটাই ছিল কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যার প্রথম বক্তব্য। সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। শেখ রেহানা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে তার বাবার হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করেন। ১৯৮০ সালে তিনি তার স্বামী ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষের আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসির সঙ্গে হাউস অব কমন্সে দেখা করেন। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ব লন্ডনের মাইল্যান্ড ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের এক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি প্রধান বক্তা ছিলেন। সেখানে স্যার টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অব কমন্সের কাছে একটি রেস্তোরাঁয় স্যার টমাস উইলিয়ামস আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। এ কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি নিজে এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সদস্য। তদন্তের জন্য জেফরি টমাস এমপি ও সলিসিটর অ্যাব্রে রোজ ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড ক্যারিংটনসহ অনেকে এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করে।

২০০৭ সালে ১/১১ সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর যখন দলকে ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়, শেখ হাসিনাকে দল থেকে মাইনাস করার অপচেষ্টা হয়, সে সময় শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন। তার মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় গভীর সংকট থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে একনিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন শেখ রেহানা। পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সংগ্রামেও সবসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকেছেন, দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরসা জুগিয়েছেন, অনবদ্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটানা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও কখনো সরকার বা রাজনীতিতে দেখা যায়নি শেখ রেহানাকে। তবে অতিসাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত শেখ রেহানা মানুষের কল্যাণে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকেছেন নির্মোহভাবে। এটিও সহজেই অনুমেয়, শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার নিঃস্বার্থ সহচর। এভাবেই শেখ হাসিনার সংকটে ও সংগ্রামে আজন্ম সঙ্গী হয়ে রয়েছেন শেখ রেহানা।

লেখক : মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছাত্রলীগ কর্মীকে ধরে পুলিশে দিল জনতা

রাস্তাতেই রাত কাটিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা 

কেমন কাটতে পারে আজকের দিন, জেনে নিন রাশিফলে

ভারতের ‘আরেকটি অভিযানের’ ভয় করছে পাকিস্তান

দুপুরে যেসব জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড় হতে পারে

‘বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়ি থেকে যাব না’

পারস্য উপসাগর / ইরানের চাপে নাম পরিবর্তনের ভাবনা থেকে সরছে যুক্তরাষ্ট্র

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

ইসরায়েলকে ছাড় দিয়ে ইরানকে টার্গেট করছে যুক্তরাষ্ট্র, অভিযোগ আরঘচির

টিভিতে আজকের খেলা

১০

১৫ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১২

১৫ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

সীমান্তে বজ্রপাতে বিজিবির সদস্যের মৃত্যু

১৪

সীমান্তের ভুল তথ্য দিয়ে হয়রানি, ভুয়া এনএসআই সদস্য আটক

১৫

হাসপাতাল থেকে পালালেন ছাত্রলীগ নেতা, ৪ পুলিশ ক্লোজড

১৬

৪ মাসের শিশু চুরি, ৬ দিন পর গ্রেপ্তার নিঃসন্তান দম্পতি 

১৭

চুরির সন্দেহে কিশোরকে মারধর, পরে বস্তাবন্দি করে ফেলা হলো নদীতে

১৮

সীমান্তে ‘পুশইন’ করা সেই ৪৪ বাংলাদেশিকে থানায় হস্তান্তর

১৯

এয়ার টিকিট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মতবিনিময় সভা 

২০
X