ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

এখনই থামাতে হবে নৈরাজ্য

এখনই থামাতে হবে নৈরাজ্য

‘কোথাও কিছু একটা ঘটছে! তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে অঘটনঘটনপটীয়সীরা। নখ-দাঁতে শান দিচ্ছে নরঘাতকরা। মরণঘাতী অস্ত্র সজ্জিত হচ্ছে মধ্যযুগীয় আক্রোশে। বিচ্ছিন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভদ্রলোকদের নীরবতায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্রবাদ। রুখে না দাঁড়ালে এ ক্রান্তিকালে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ’। বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই এ ধরনের আশঙ্কা বহুল চর্চিত বিষয়। কখনো কখনো সত্যি সত্যি এর ভয়াল থাবার শিকার হয়েছে এ জনপদের মানুষ। আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রয়োজনে শুধুই প্রচার-অপপ্রচারের দামামা বেজে উঠেছে। তবে আশার কথা, দেশের বেশিরভাগ মানুষই শান্তিপ্রিয়। তারা সবসময় পরিশ্রম করে একটি নিরাপদ জীবনের জন্য। খুব বেশি সম্পদ-ক্ষমতার প্রত্যাশা করে না। দুবেলা ডাল-ভাত খেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। দিনভর পরিশ্রমের পর ইবাদত-প্রার্থনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনোদনেও স্বস্তি খোঁজে। এর ব্যত্যয় ঘটলে অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর-ওর কাছে উত্তর খোঁজে—দেশ কোথায় যাচ্ছে? হাজার বছরের ঐতিহ্য কেন কতিপয় উগ্র লোকের আচানক জেহাদি জোশে ঝুঁকিতে পড়ে। সম্প্রতি এরকম অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে দেশ।

জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারকে হটিয়ে একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার কাজ শুরু করে অভ্যুত্থানকারীরা। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যায় দলগুলোর মধ্যে। ভাগ বুঝে নিতে পুরোনোর পাশাপাশি একের পর এক নতুন দল গঠন করে বিপ্লবীরা। দল বেঁধে এগিয়ে আসে বিভিন্ন তরিকার মৌ-লোভীরা। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে সংস্কার-বিচার যুগপৎভাবে এগিয়ে গেলেও নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে শুরু হয় যত অনিশ্চয়তা। সংগঠন, জনসমর্থন না থাকলেও সংসদীয় আসন চাই-ই চাই। এজন্য নানা বাহানায় রাজপথ এবং আলোচনার টেবিল উত্তপ্ত করেছে কয়েকটি ধর্মাশ্রয়ী দল। সুবিধা করতে না পেরে বিভিন্ন সময় ছাত্র-জনতার নামে নানা ইস্যুতে মব সন্ত্রাস করেছে তারা। প্রতিটি হামলার পর সব দলই সুবিধামতো কমবেশি নিন্দা জানিয়েছে। সরকারের ব্যর্থতায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নির্দিষ্ট কোনো দলকে দায়ী করা যায়নি। এতে করে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী ও ছিঁচকে লুটেরা। শুরু থেকেই বিভিন্ন দুর্বলতা নিয়ে এগোতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এমনকি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের নির্দেশ মানে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ভিন্নমত ও বাউলদের ওপর আক্রমণ, মাজার ভাঙচুর, স্বাধীনতা-ঐতিহ্য-সাংস্কৃতিক স্মারকের ধ্বংস ঠেকাতে পারেনি রাষ্ট্র। বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা এবং লুট হয়েছে প্রকাশ্যে। লুটকারীরা হাসতে হাসতে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারেনি বা হয়নি। পরে ঘটনাস্থলে গেলেও তাদের জোরালো কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। উল্টো মবকারীরা তাদের লক্ষ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়েছে। দিন দিন বিভিন্ন বাহিনী তাদের শৌর্য হারিয়ে সাধারণ নিরাপত্তা কর্মীতে পরিণত হচ্ছে। হাসিনা রেজিমে চরম অপব্যবহারের শিকার হয়েছে পুলিশ। জুলাই বিপ্লবে এর মাশুল দিয়েছে তারা। দীর্ঘদিনেও ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা আর কতদিন চলবে? এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়ে গেছে। নানামুখী মব সন্ত্রাসের সর্বশেষ শিকার জনপ্রিয় গণমাধ্যম ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-উদীচী এবং পোশাককর্মী দিপু চন্দ্র দাস। সংবাদকর্মীদের ভেতরে রেখে পত্রিকা অফিসে নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। ভাঙচুর এবং লুটপাট করেছে সন্ত্রাসীরা। এখানে ধর্মীয় কী বার্তা দিতে চায় তারা? হামলাকারীদের চোয়াড়ে চেহারা, সন্ত্রাসী আচরণ কোনোভাবেই ধার্মিক মানুষ বলে মনে হয় না। অনেকে সন্দেহ করছে, জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতেই একটি ধর্মাশ্রয়ী দল বিভিন্ন মব গ্রুপ তৈরি করেছে। বিভিন্ন সময় কোরআন এবং নবীজিকে অবমাননা করা হয়েছে বলে মব সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। গত ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু দাসের হত্যাকাণ্ড তারই এক দৃষ্টান্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল উন্মত্ত লোক তাকে পিটিয়ে হত্যা করে তার বিবস্ত্র লাশটি গাছে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। র্যাব জানিয়েছে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দিপুকে হত্যা করা হয়েছে। তবে, বিষয়টি অস্পষ্ট। কী বলে ধর্ম অবমাননা করেছেন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন? সেই তথ্য-প্রমাণ নেই। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, সহকর্মীদের কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে মব সহিংসতা উসকে দিয়েছে।

দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৭ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন মো. কাশেম ফারুক, মো. সাইদুর রহমান, রাকিব হোসেন, মো. নাইম, ফয়সাল আহমেদ প্রান্ত, মো. সোহেল রানা ও মো. শফিকুল ইসলাম। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার কাশেম বগুড়ার আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা। গ্রেপ্তার সাইদুর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নোয়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। গ্রেপ্তার রাকিব শেরপুর জেলার বাসিন্দা। তিনি প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত হয়েছেন। তার আইডি থেকে ধ্বংসস্তূপের ছবি তুলে পোস্ট করা হয়। তিনি ফেসবুকে তার আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্টও করেন। এ ঘটনায় লুট হওয়া ৫০ হাজার টাকাসহ ঢাকার তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাইমকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাইম স্বীকার করেছেন, তিনি ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা লুট করেছেন। লুট করা টাকা দিয়ে তিনি মোহাম্মদপুর থেকে একটি টিভি ও একটি ফ্রিজ কেনেন, যা এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সোহেলকে। তার বিরুদ্ধে মাদকসহ অন্যান্য আইনে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে। একই এলাকা থেকে গ্রেপ্তার শফিকুলের বিরুদ্ধে অতীতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত অপরাধীদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে তাদের ধর্মপ্রাণ বলে মনে হয় না। ভাড়াটে দলীয় কর্মী হলে হতে পারে। তবে, তারা আসলে লুটকারী। ধর্মীয় অনুভূতির জিকির তুলে বিভিন্ন সময় এ দেশে হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হয়েছে। সেসব আক্রমণকারীর বেশিরভাগই ষণ্ডামার্কা লোক। তারা নিয়মিত নামাজ পড়ে না, রোজা করে না। ইসলামের শান্তির বার্তায় বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু গুজবে কান দিয়ে মুহূর্তে অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। পরে, হত্যা-লুট-দখলের মাধ্যমে অনুভূতি শান্ত করে। ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্রীর হাতের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুগে যুগে এরা ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মান্ধ হিন্দু বা মুসলিম পরিচয়ে দাঙ্গা বাধিয়েছে। বাংলাদেশে উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠায় খুব ছোট পরিসরে এরকম কিছু লোক অনেক দিন ধরে চেষ্টা করে আসছে। জনসমর্থন না পাওয়ায় এতদিন বিস্তৃত হতে পারেনি। বর্তমানে অরাজনৈতিক ভদ্রলোক সরকারের দুর্বলতার সুযোগে আবারও মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।

জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনার সঙ্গে অনেকে তাল মেলাতে পারছেন না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এখনো পুরোনো ইমেজ ব্যবহার করছে। কেউবা আবার আগের মতোই ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এ এক অস্থির সময়! এটাকে ধরতে হলে মুক্ত হস্তে এগোতে হবে। টাকা ঢেলেও ফাঁকা পূরণ করা যাবে না। নতুন আইডিয়া, দেশপ্রেম, সততা, বিনয়, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। দেড় হাজার প্রাণের বিনিময়ে দেড় দশকের অপমান তাড়িয়েছে জাতি। নতুন করে কারও প্রভুত্ব মানবে না। সবার আগে দেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আরও যত্নশীল ও কৌশলী হতে হবে আগামীর নেতৃত্বকে। ধর্মের নামে উন্মাদনা আর নৈরাজ্য করলে আধুনিক, সভ্য রাষ্ট্র গড়া যাবে না। সুযোগ বারবার আসে না। কানাডীয় শিক্ষাবিদ লরেন্স জে পিটার বলেছেন, ‘ভাগ্য দরজায় একবারই কড়া নাড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেক ধৈর্যশীল, বারবার কড়া নেড়েই যায়।’ বাংলাদেশের বেলায় কথাটি খুবই প্রাসঙ্গিক। তারপরও একাত্তর, নব্বই হয়ে চব্বিশ সুযোগ বয়ে এনেছে। রাজনীতিবিদরা এর সদ্ব্যবহার করতে না পারলে পস্তাবে। জবরদস্তিমূলক কিছু করা যাবে না। জবরদস্তি মানেই ফ্যাসিবাদ। সেটা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।

লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নতুন বছরে চমক দেখাতে প্রস্তুত বলিউড

টানা ৪২ ঘণ্টা গান গাইলেন স্যান্ডউইচ বিক্রেতা

প্যারিসে হাদি হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে সমাবেশ

হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আজ

ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত নীলফামারীর জনজীবন

এক আসনে মনোনয়ন কিনলেন আপন ২ ভাই

বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও এসপিদের সঙ্গে ইসির বৈঠক আজ 

আজ টানা ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়

ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

কুড়িগ্রামে শীতে জনজীবন স্থবির, তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি 

১০

ইরানের যে কোনো হামলার কঠোর জবাবের হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর

১১

আমরা একটা বৈষম্যহীন সমাজ চাই: ড. এম এ কাইয়ুম

১২

যাত্রী ওঠানামা নিয়ে বিরোধ, চাচার হাতে ভাতিজা নিহত

১৩

ঢাকায় শীত নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা 

১৪

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১৫

বুধবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৬

রাজধানীতে ১৪ তলা ভবনে আগুন

১৭

২৩ ডিসেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

তিন দিন করে রিমান্ডে দিপু হত্যার ১২ আসামি

১৯

বেরোবিতে হাদি-আবরারের নামে ভবনের নামকরণ করলেন শিক্ষার্থীরা

২০
X