পুরো পৃথিবী মহান আল্লাহর সৃষ্টি, পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় মুসলমান পালন করতে পারেন ইবাদত ও প্রার্থনা। তবে বিশেষভাবে তিনটি শহরকে সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে ইসলামে। হাদিসের আলোকে জানা যায়, তিনটি শহর বিশেষভাবে সম্মানিত—মক্কা, মদিনা ও ফিলিস্তিন বা বায়তুল মুকাদ্দাস। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইবাদতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে চাইলে তিনটি মসজিদেই ভ্রমণ করা যাবে—মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ (মসজিদে নববী) ও মসজিদুল আকসা।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮২৭)। এ হাদিস থেকে তিন শহরের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝা যায়। এ ছাড়া এ তিন মসজিদে নামাজ আদায়ে রয়েছে বিশেষ সওয়াবের ঘোষণা। পৃথিবীর অন্যান্য মসজিদের তুলনায় মক্কা, মদিনা ও আকসা—এ তিন মসজিদে নামাজের সওয়াব বেশি। আবু দারদা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মসজিদে হারামে (কাবাঘর) এক রাকাত নামাজ এক লাখ রাকাত নামাজের সমান। আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক রাকাত নামাজ এক হাজার রাকাত নামাজের সমান এবং বায়তুল মাকদিসে এক রাকাত নামাজ পাঁচশ রাকাত নামাজের সমান।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৪/১১)। এজন্য যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বছরে একবার এ তিন মসজিদ ভ্রমণ করে আসছেন। পবিত্র হজ পালন উপলক্ষে সাধারণত এসব ভ্রমণ হয়ে থাকে। তবে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র করে প্রায় শতাব্দীকাল চলমান যুদ্ধের কারণে শেষোক্ত মসজিদ ভ্রমণ জটিলতর হয়ে আছে।
বিশ্ব মুসলিমের প্রথম পবিত্রভূমি ও প্রাণকেন্দ্র মক্কা নগরীর কাবাঘর। প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে এ ঘরের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান। কারণ কাবাঘরের দিকে মুখ করে গোটা মুসলিম উম্মাহ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। আবার প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে কাবাঘর জিয়ারতে আসে মুসলিমরা। আল্লাহতায়ালা কাবাকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা করেছেন এবং সে সঙ্গে তার আশপাশে কিছু স্থান ও বিষয়কে ‘শাআইরুল্লাহ’ তথা ‘আল্লাহর নিজস্ব পরিচয়-চিহ্ন’ বলে নির্ধারণ করেছেন। ভৌগোলিকভাবে গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান, যা পৃথিবীর নাভি হিসেবে বিবেচিত। হাদিসের ভাষ্যমতে, কাবার নিচের অংশ পৃথিবীর প্রথম জমিন। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে সেখানে পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা নির্মাণ করা হয়। আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ফেরেশতারা। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এই ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত এবং বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’ (সুরা আলে-ইমরান : ৯৬)
হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা এ ঘর নির্মাণ করেন। আদম (আ.) পৃথিবীতে আসার পর আল্লাহতায়ালার হুকুমে পুনরায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং কাবাকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির নির্দেশ পান। হজরত নুহ (আ.)-এর যুগে মহাপ্লাবনে এ ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.)। নির্মাণের পর আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে বিশ্ববাসীকে এ ঘর জিয়ারতের আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ (সুরা হজ : ২৭)। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আহ্বানের পর থেকে আজ পর্যন্ত কাবাকেন্দ্রিক ইবাদত ও জিয়ারত বন্ধ হয়নি।
কাবাকেন্দ্রিক ইসলামের অনেক ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই ও মৃত ব্যক্তির দাফনসহ অনেক ইবাদত আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরে। কাবা চত্বরে রয়েছে বরকতময় বহু নিদর্শন। মাকামে ইব্রাহিম, মুলতাজিম, হাজরে আসওয়াদ, মিজাবে রহমত, হাতিম, মাতাফ, রুকনে ইয়েমেনি; প্রত্যেকটি বরকতের আধার। এগুলোর কাছে গিয়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়। কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এ স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া। দোয়া কবুলের জন্য হাতিম উত্তম স্থান। হাতিমের ঠিক ওপরে কাবা শরিফে ঘরের ছাদের সঙ্গে একটি স্বর্ণের পরনালা আছে। বৃষ্টির সময় এ পরনালা দিয়ে ছাদের পানি পড়ে। সেজন্য এর নাম মিজাবে রহমত। মিজাবে রহমতের নিচে বসে দোয়া করলে কবুল হয়। পবিত্র মক্কা নগরী ও কাবাঘরের পর ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র নগরী মদিনা ও দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ নববী মসজিদ। মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়ে রাসুল (স.) নিজ হাতে তৈরি করেন এ মসজিদ। তাই এর সঙ্গে মিশে আছে সারা বিশ্বের মুসলমানের শ্রদ্ধা ও আবেগ। মদিনায় প্রবেশের পর রাসুল (স.)-এর উটনি ‘কাসওয়া’ যে স্থানটিতে বসে পড়েছিল, সেই স্থানেই তৈরি করা হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববী। মদিনার দুই এতিম বালক সাহল ও সোহাইলের কাছ থেকে ১০ দিনারের বিনিময়ে জায়গা কিনে নেওয়া হয়, যা হযরত আবু বকর (রা.) পরিশোধ করেন। জমির ছোট এক অংশে রাসুল (স.)-এর জন্য বাসস্থান এবং বাকি পুরো অংশে তৈরি করা হয় মসজিদ। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন ওমরের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল (সা.)-এর যুগের মসজিদের ভিত্তি ছিল ইটের, ছাদ ছিল খেজুরের ডালের এবং খুঁটি ছিল খেজুর গাছের কাণ্ডের। সে সময় মসজিদের পরিধি ছিল আনুমানিক ২৫০০ মিটার। সপ্তম হিজরিতে মসজিদে নববীর প্রথম সম্প্রসারণ রাসুল (স.) নিজেই করেন। তখন আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৫ স্কয়ার মিটারে। এরপর ৬৩৮ সালে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীর সংস্কারে হাত দেন। মসজিদের চারপাশে জমি কিনে এর আয়তন বৃদ্ধি করেন। তবে যেদিকে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের ঘর ছিল সেদিকটা অপরিবর্তিত রাখা হয়। এরপর ৬৫০ সালে তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) মসজিদে নববী সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি সর্বপ্রথম খোদাইকৃত পাথর ও প্লাস্টারের দেয়াল তৈরি করেন এবং খোদাইকৃত পাথর ও লোহার ব্যবহারে পিলার ও স্তম্ভ স্থাপন করেন। আর ছাদ নির্মাণ করেন কাঠ দিয়ে। ৭০৭ সালে খলিফা উমাইয়া শাসক ওলিদ ইবনে আবদুল মালিকের নির্দেশে মক্কার গভর্নর ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করেন। সে সময় মসজিদের পরিধি বৃদ্ধি হয় ৬ হাজার ৪৪০ বর্গমিটার। তিনি মসজিদে চারটি মিনার ও একটি মেহরাব স্থাপন করেন। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলোকে মরমর পাথর ও সোনার কারুকার্জ দিয়ে সাজান। এ সময় স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ২৩২টি। তিনি হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষটি মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার ওপর নয়নাভিরাম সবুজ গম্বুজ স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, সবুজ গম্বুজস্থ ঘরে রাসুল (সা.)-এর পাশে হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত ওমর (রা.)-এর কবর এবং তৃতীয় একটি খালি কবর রয়েছে, যাতে কাউকে দাফন করা হয়নি। গবেষক আলেমদের মতে, হজরত ইসা (আ.) যখন পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন, তখন তার স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পর তাকে এখানেই দাফন করা হবে।
পবিত্র মক্কা ও মদিনার পর ফিলিস্তিনের ‘কুদস’ মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান। এ কুদস নগরীতেই রয়েছে ঐতিহাসিক ‘মসজিদুল আকসা’। নানা তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছেও মসজিদুল আকসা আবেগের জায়গা। কারণ এ মসজিদ ঘরে তিন ধর্মেরই রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিকড়ের সম্পর্ক। মসজিদুল আকসা অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি। এ মসজিদ ঘিরে আছে নবী দাউদ ও সোলায়মান (আ.)-এর রাজ্যশাসনের স্মৃতি, নবী ইসা (আ.)-এর জন্মের স্মৃতি ও নবী মুহম্মদ (সা.)-এর ঐতিহাসিক মিরাজ ভ্রমণের স্মৃতি ও মুসলমানদের প্রথম কিবলার ইতিহাস; হিজরতের পর ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করত। নবী দাউদ ও সোলায়মান (আ.)-কে ইহুদিরা কেন্দ্রীয় পুরুষ হিসেবে স্মরণ করে, নবী ইসা (আ.)-কে খ্রিষ্টানরা কেন্দ্রীয় পুরুষ হিসেবে স্মরণ করে। মুসলমানরা দুই ধর্মের নবীকেও বিশ্বাস করে এবং শেষ নবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-কেও বিশ্বাস করে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিন ভূমির বর্ণনা এসেছে, যা এই পবিত্র ভূমির বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে। বর্ণিত হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছি বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ১)।
মসজিদুল আকসা পৃথিবীর দ্বিতীয় নির্মিত মসজিদ। এর নির্মাতা প্রথম মানব আদম (আ.)। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম (কাবাঘর)। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, এ দুইয়ের নির্মাণের মাঝখানে কত পার্থক্য? তিনি বললেন, ৪০ বছর। (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৩৪২৫)। মসজিদুল হারামের মতো মসজিদুল আকসাও একাধিকবার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। আদম (আ.)-এর পর খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ইব্রাহিম (আ.)-এর পুনর্নির্মাণ করেন। তার বংশধরদের ভেতর ইসহাক ও ইয়াকুব (আ.) পবিত্র এ মসজিদের পরিচর্যা করেন। অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে সোলায়মান (আ.) মসজিদুল আকসা পুনর্নির্মাণ করেন।
মসজিদুল আকসা নির্দিষ্ট কোনো স্থাপনার নাম নয়। বরং ফিলিস্তিনের কুদস শহরের নির্দিষ্ট এলাকার পুরোটাই মসজিদুল আকসা। প্রায় ১৪৪ একর ভূমির ওপর আল আকসা কম্পাউন্ড অবস্থিত, যা প্রাচীন জেরুজালেম শহরের ১৬.৬ ভাগের এক ভাগ। আল আকসা কম্পাউন্ড অর্ধ-আয়তাকার। এর পশ্চিম দিক ৯৪১ মিটার, পূর্ব দিক ৪৬২ মিটার, উত্তর দিক ৩১০ মিটার এবং দক্ষিণ দিক ২৮১ মিটার প্রশস্ত। কম্পাউন্ডের ভেতরে মসজিদুল আকসা ছাড়াও একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। যেমন—সোনালি বর্ণের কুব্বাতুস সাখরা। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ৭২ হিজরিতে এটি নির্মাণ করেন। এর পাশেই কিবলি মসজিদ নির্মাণ করেন খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। আল আকসা কম্পাউন্ডে ছোট-বড় ২০০ স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে আছে মসজিদ, গম্বুজ, আঙিনা, মিহরাব, মিম্বার, আজানের স্থান, কূপ ইত্যাদি। এসব স্থাপনার মধ্যে কুব্বাতুস সাখরার অবস্থান আল আকসা কম্পাউন্ডের ঠিক মধ্যখানে। কিবলি মসজিদের অবস্থান সর্বদক্ষিণে। এ মসজিদের সাতটি আঙিনা ও বারান্দা রয়েছে। কম্পাউন্ডের প্রবেশপথ ছয়টি। কম্পাউন্ডের ভেতর ২৫টি সুপেয় পানির কূপ। রয়েছে বেশ কয়েকটি পানির ফোয়ারা। পাথর আচ্ছাদিত কায়েতবাই ফোয়ারাটিই সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। আরও আছে ৪০টি উঁচু আসন। যেখানে বসে প্রাজ্ঞ আলেমরা ধর্মীয় জ্ঞানের পাঠদান করে থাকেন। এসব স্থাপনা বিভিন্ন শাসনামলে নির্মিত।
তিন ধর্মের পবিত্র নগরী ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা হাজার বছরের ইতিহাসে অনেকবার মালিকানা বদল হয়েছে। এ নগরী ঘিরে চলছে যুদ্ধ ও সন্ধি। ১৫ হিজরি মোতাবেক ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম বাহিনী ফিলিস্তিন ভূমি জয় করেন এবং আল আকসা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। বিজয়ের পর খলিফা ওমর (রা.) ফিলিস্তিন সফর করেন। তখন তার সঙ্গে ছিলেন আবু উবাইদা আমের ইবনুল জাররাহ, সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস, খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আবু জর গিফারি (রা.)-সহ সাহাবিদের একটি দল। ওমর (রা.) একটি সন্ধিচুক্তির অধীনে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আল আকসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিন ধর্মের লোকদেরই উপাসনার অধিকার প্রদান করেন। তবে ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টানরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আল আকসা দখল করে এবং ইহুদি-মুসলিমদের ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ধ্বংস করে ইসলামের বহু ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। কেড়ে নেয় মুসলিম ও ইহুদিদের উপাসনার অধিকার। ১১৮০ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের শাসক সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) পুনরায় খ্রিষ্টানদের হাত থেকে ফিলিস্তিন ভূমি মুক্ত করেন। তখন থেকে মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল মসজিদুল আকসা। ছিল তিন ধর্মের মানুষের উপাসনার অধিকার। তারপর ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের উসমানি খেলাফতের পরাজয় হলে আল আকসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের একাংশে ইহুদিদের মালিকানা প্রদান করে এবং মসজিদুল আকসার দায়িত্ব হস্তান্তর করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের মিত্র জর্ডানের শাসকের হাতে। ফলে মসজিদুল আকসা বর্তমানে জর্ডানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন সম্পত্তি। তবে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মসজিদুল আকসার নিরাপত্তার দায়িত্ব ভাগ করে নেয় ইসরায়েল সরকার এবং মসজিদ পরিচালনার ভার প্রদান করে যৌথভাবে ইসলামী ওয়াকফ ট্রাস্টের হাতে। ইসলামের পবিত্র এ ভূমিতে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নানা কারণে এক অনিঃশেষ যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজমান।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ